ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঢাবির ৫ হাজার শিক্ষার্থী

ঢাবি
  © লোগো

আহামেদউল্যাহ সিয়াম, পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ফর স্পিকারস অব আদার ল্যাগুয়েজ (ইএসওএল) বিভাগে। নিজের পড়ালেখার খরচ চলত পরিবারের দেয়া কিছু টাকা ও টিউশন থেকে প্রাপ্ত অর্থে। এর মধ্যে পৃথিবীতে হানা দিলো মহামারী করোনা ভাইরাস। স্থবির হয়ে গেল গোটা বিশ্ব। বন্ধ হয়ে গেল সায়েমের আয়ের দরজা। তিনি ভাবতে শুরু করলেন কিভাবে পড়ালেখার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়া যায়; বেছে নিলেন অনলাইনে মাছ বিক্রির পরিকল্পনা। যেই ভাবা সেই কাজ ‘ইলিশের বাড়ি’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে তার পণ্যের প্রচারণা শুরু করলেন। প্রথম দিকে শুধু ইলিশের সিজনে মাসিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার বিক্রি হলেও এখন তার মাসিক বিক্রি দাঁড়িয়েছে দুই লক্ষ টাকারও বেশি।

শুধু আহামেদউল্যাহ সিয়াম নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম হাজারও শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা পড়ালেখার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত বিজনেস উদ্দেশ্যে করা ফেসবুক গ্রুপ ‘ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি’র (ডিবিসি) এডমিন প্যানেলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এরকম ৫ হাজার বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা পড়ালেখা কিংবা চাকরির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে বর্তমানে এ পেশায় নিয়মিত আছেন প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে বর্তমান শিক্ষার্থীই রয়েছে প্রায় শতাধিক। অনেকে আবার চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন>>ঢাবির হলে চুরি, চোরকে দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করালেন শিক্ষার্থীরা

আহামেদউল্যাহ সিয়াম বলেন, করোনা মহামারীতে সবকিছু বন্ধ হওয়ার পর আমি ভাবলাম এমন কি করা যায় যেটা হবে স্বাধীন পেশা। অনেক সিনিয়রের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে শুরু করলাম ইলিশ বিক্রি। যেহেতু আমার বাড়ি চাঁদপুর জেলায় এজন্য খুব সহজেই এটা করতে পেরেছি। প্রথম দিকে শুধু দুই মাস ইলিশ বিক্রি করেছি। কিন্তু পরবর্তীতে আমার বিক্রি যখন ভালো হওয়া শুরু করলো তখন ইলিশ মাছের পাশাপাশি অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ বিক্রি শুরু করলাম। প্রথম দিকে খুব কম আয় হলেও এখন প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। 

শিক্ষার্থীদের পরিচালিত এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন- মধু, খেজুর, রস মালাই, গুড়; নানা ধরনের পোশাক, মেয়েদের সৌন্দর্য্য চর্চার বিভিন্ন প্রসাধনী থেকে শুরু করে রান্না করা খাবার। অনেকেই আবার ফেসবুক পেইজ থেকে তাদের স্টকে থাকা পণ্যের ছবি দিয়ে প্রচারণা চালান। গ্রাহক তার পছন্দের পণ্যটি সরাসরি অথবা অনলাইনে দেখে নিতে পারেন খুব সহজেই।

এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রচারণার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম ‘ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি’ (ডিবিসি) ফেসবুক গ্রুপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অথবা এখানে অধ্যয়নরত প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী যুক্ত রয়েছেন এ প্লাটফর্মটিতে। এখান থেকে যে কেউ তাদের পছন্দের পণ্যটি খুব সহজেই কিনতে অথবা বিক্রি করতে পারেন। তাছাড়া অনেকের আবার রয়েছে নিজস্ব ফেসবুক পেইজ যেখানে তাদের কাছে থাকা পণ্যের ছবি ও তথ্য দিয়ে প্রচারণা চালান।

করোনা মহামারীর সময় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এসব পেশায় জড়িয়ে পড়েন। এর বড় কারণ এই সময় শিক্ষার্থীদের আয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের খরচ বহন করতে হয়। যার কারণে অনেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েন।

সিয়াম বলেন, আমি সফল হওয়ার পর দেখেছি অনেক শিক্ষার্থী আমার কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। অনেকেই আবার আমার কাজের প্রশংসা করে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ভালো লাগার ব্যাপার হচ্ছে এদের মধ্যে অনেকেই আবার আমার মতো উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন। এসব দেখে ভালো লাগা কাজ করে। আমি এ কাজের ফলে এখন পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পারছি। সর্বোপরি এটি একটি স্বাধীন ও মুক্ত পেশা।

সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে কথা হয় বাংলাদেশ মোমেন্টস-এর। এদের মধ্যে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে মতিন মাহমুদ খুলেছেন ‘আল-মানাম ফুড এন্ড এনার্জি’ নামের একটি ফেসবুক পেইজ। যেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু যে কেউ নিতে পারছেন তার পছন্দের বিভিন্ন ধরনের খাবার। পছন্দের পেশা হওয়ায় চাকরির পাশাপাশি একেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মতিন। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

মতিন বলেন,' আমি ছাত্র অবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিজনেস শুরু করেছিলাম, আমার নিজস্ব বাড়ির শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি দিয়ে। আমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছি কিন্তু বড় ধরনের ব্যবসা করার জন্য অনেক পুঁজির প্রয়োজন যা আমার বর্তমানে নেই। তাছাড়া, বর্তমান সমাজ শিক্ষাটাকে চাকরির সহোদর হিসেবেই নেয়। তাই আমাকেও সমাজের স্রোতে ভাসতে হবে। একটা সরকারি জব করার পাশাপাশি বিজনেস করলে তখন বিজনেস করাটাও অনেকটা সহজ হবে। ভালো একটা আইডেন্টিটির সাথে উঁচু স্তরের মানুষের সাথে মেশার সুযোগটা ব্যবসার মাধ্যমে খুব সহজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তাই আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো একটা জব করার পাশাপাশি বিজনেস চালু রাখা।

এসব সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভাষ্য, শুধু চাকরির পিছনে না ছুটে নিজেকে স্বাধীন পেশায় যুক্ত করতে ও দ্রুত স্বাবলম্বী হওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হতে পারে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসা। এতে করে এগিয়ে যাবে সমাজ ও সেই সাথে এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতির চাকা। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেশের তরুণ প্রজন্ম।