চায়ের স্বাদে জীবিকা অর্জন প্রতিবন্ধী যুবকের
- ঈশ্বরদী(পাবনা) প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৪৯ PM , আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৪৯ PM

পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মানাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক গ্রীণসিটির পাশে নতুনহাট গোলচত্বর মোড়েই শারিরীক প্রতিবন্ধী ফারুকের চায়ের দোকান। তার মালাই চায়ের কদর পুরো জেলা জুড়ে। ফারুকের চায়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় দুর-দুরান্ত থেকে চা পান করতে মানুষ এখানে ছুটে আসেন। রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত বিদেশী নাগরিকরা তার মালাই চা পছন্দ করেন। শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দু'দিন ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় ফারুককে। তাই এ দু'দিন ফারুকের চায়ের স্বাদ নিতে দোকানের সামনে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয় চা প্রেমীকদের। জন্ম থেকেই ডান হাত বাঁকা ও শক্তি প্রয়োগ করে কোন কাজ করতে পারেন না এ চা দোকানী ফারুক হোসেন। শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েও চায়ের স্বাদ বিক্রি করে টিকে রয়েছে জীবন সংগ্রামে। দারিদ্র্যতা আর অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে না পারা প্রতিবন্ধী এ যুবক বেশ কয়েক রকমের চা বিক্রি করে খ্যাতি অর্জন করেছে জেলাজুড়ে।
শুক্রবার(১ সেপ্টেম্বর) সন্ধার সময় বক্কারের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, গুন গুন করে গান আর চায়ের কাপের চামচের ঠন ঠন শব্দে মুখরিত তার চায়ের দোকান। দোকানের ভিতরে ও বাহিরে বেশ অনেকেই বসে চা পান করছেন। চা পান করানোর পাশাপাশি ক্রেতাদেরকে তার কন্ঠে গান শুনিয়েও বেশ বিনোদন উপভোগ করাচ্ছেন। আবার অনেকেই চায়ের চুমুক দিয়ে রাজনৈতিক আলাপ- আলোচনা করছেন। ক্রেতাদের কথা ভেবে দোকানের পাশে থাকা কদম গাছের চারপাশ জুড়ে বসার জন্য তৈরি করেছে টাইলসযুক্ত পাকা বেঞ্চ। বেশ কয়েকজন বসার জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই চা পান করছেন। বক্কার চা বানাতে ও মানুষের হাতে চায়ের কাপ পৌঁছে দিতে ব্যস্ত রয়েছেন।
নতুনহাট গোলচত্বর মোড়ের স্থানীয় কয়েকজন দোকানী বলেন, ২০ বছর ধরে চায়ের ব্যবসা করছেন ফারুক হোসেন। সে যে একজন প্রতিবন্ধী এটা কখনও মনেই হয়না। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি মালাই চা বিক্রি করছেন। তার মালাই চা খেতে দুর-দুরান্ত থেকে মানুষজন আসে। বিশেষ করে রূপপুর প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ান নাগরিক, প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার চা খুব পছন্দ করেন। এছাড়াও পাবনা সদর, লালপুর ও ঈশ্বরদী শহর থেকে মানুষজন মালাই চা খেতে ছুটে আসেন। তিনি আরো বলেন, মালাই চায়ের পাশাপাশি ফারুকের দুই লেয়ার চা, দুধ চা, মাল্টা চা ও লাল চায়ের বেশ সুনাম রয়েছে। অনেকেই তার লাল চা বেশ পছন্দ করেন।
ঈশ্বরদী পৌর এলাকার মশুরিয়া পাড়া থেকে আসা শেখ তুষার বলেন, আমি ঈশ্বরদী শহর থেকে ফারুক ভাইয়ের চা খাওয়ার জন্য এসেছি। শহর থেকে ফারুকের চায়ের দোকান প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে। এ দোকানে প্রায়ই চা খেতে আসি । এখানে ঈশ্বরদী শহর, পাবনা জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন চা খেতে আসে। বিদেশী নাগরিক, সেনা সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, রুপপুর প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের এখানে চা খেতে দেখি। শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধি হয়েও তার যে জীবন সংগ্রাম এবং তার এক হাত দিয়ে তৈরি চায়ের স্বাদ তা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
উপজেলার মানিকনগর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন চা খেতে এসে বলেন, সময়-সুযোগ হলেই ফারুক ভাইয়ের দোকানে চা খেতে আসি। তার তৈরি ৪ রকমের চায়ের প্রতিটিই আমার কাছে ভালো লাগে। আমি মালাই চা ও দুধ চা বেশি পছন্দ করি। তার চা অসাধারণ। যা বলে বুঝানো যাবে না। আমি যখনই আসি তখনই দেখি ভিড় লেগেই আছে। এ দোকানে বেশি ভিড় হয় সন্ধ্যার পর। চা খাওয়ানোর পাশাপাশি তার কন্ঠে গানও শুনি আমরা। এতে দীর্ঘ সময় নিয়ে এ দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া যাই। শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েও এক হাত দিয়ে বানানো চায়ের যে স্বাদ তিনি করেন তা প্রশংসনীয়।
চায়ের দোকানদার মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, মালাই চা তৈরি হয় গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে। দুধ ৭/৮ ঘন্টা জ্বালিয়ে এ চা তৈরি করা হয়। সেজন্য এ চা খুব সুস্বাদু। তিনি বলেন, পাঁচ ছয় বছর আগে নতুনহাট এলাকায় শীতকালীন মহড়ায় একদল সেনা সদস্য এসেছিলেন। তারা মাঝেমধ্যে চা খেতে আসতেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন আমাকে মালাই চা তৈরির বিষয়টি বলেন এবং কিভাবে এ চা তৈরি করতে হয় সেটিও জানান। তারপর থেকেই নিয়মিত মালাই চা বিক্রি করছি। ফারুক আরও বলেন, চা ভালো হওয়ায় একজন খেয়ে আরেকজনকে বলেন। এভাবেই এলাকায় আমার চায়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ কাপ মালাই চা বিক্রি হয় । এছাড়াও লাল চা (রং চা), দুধ চা ও দুই লেয়ারের চা আমি বিক্রি করি। আমার সবধরনের চায়ের কাস্টমার আছে। চায়ের দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় শুক্রবার ও শনিবার । এ দু'দিন দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ বেশি আসে। তিনি বলেন, চা দোকানের আয় দিয়ে বাবা-মা ও ভাই-বোনদের নিয়ে সুখেই আছি।