সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে জৌলুশ কি ফিরবে রাবি ছাত্রলীগের এ সম্মেলনে?

রাবি
  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন—ছাত্রলীগের রয়েছে ১২৫টি সাংগঠনিক ইউনিট। তারমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটগুলো নিয়েই বেশি হয় আলোচনা। দেশের চারটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাবি, জাবি, রাবি এবং চবির মধ্যে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতায় সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়া ইউনিট এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগ ইউনিট।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ যেন স্থবির, দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় সাংগঠনিক ইউনিট। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এই ইউনিটে প্রতি বছর বার্ষিক সম্মেলন হওয়ার কথা। কিন্তু, প্রায় সাত বছর পর সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে—যা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর। 

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিয়মিত বার্ষিক সম্মেলনের রেওয়াজও নেই ছাত্রলীগের এই ইউনিটে। ১৯৬২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৫টি সম্মেলন হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও এসময়ে রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে মাত্র তিনটি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রায় ৬ বছর পর সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সে সময় আওয়াল কবির জয়কে সভাপতি ও মাজেদুল ইসলাম অপুকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করতে পারেনি। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতেও শুরু হয় অন্তর্কোন্দল—যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় ভয়াবহ সংঘর্ষে। ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ ওরফে নাসিমের মৃত্যুর পর বহিষ্কার করা হয় জয় এবং অপুকে।

এরপর, ২০১১ সালে ২৬ জুন ছাত্রলীগের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন আহম্মেদ আলী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবু হোসাইন বিপু। ২০০৬ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন মুন ও সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিনের কমিটি প্রকাশের প্রায় ৭ বছর পর ২০১২ সালের ১৬ জুন শাখা ছাত্রলীগের ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে আহম্মেদ-বিপু পরিষদ।

২০১৩ সালের ২০ জুলাই শাখা ছাত্রলীগের ২৪তম কাউন্সিলের পর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মিজানুর রহমান রানা ও এসএম তৌহিদ আল হোসেন তুহিন। একই বছরের ৩১ জুলাই ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে রানা-তুহিন পরিষদ।

তবে কমিটি গঠনের পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, শিবিরের সাথে সংঘর্ষসহ নানা অভিযোগে প্রথমে তুহিনকে এবং পরবর্তীতে মিজানুর রহমান রানাকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২৫তম সম্মেলনের পর গোলাম কিবরিয়া ও ফয়সাল আহমেদ রুনু প্রায় ৭ বছর ধরে রাবি ছাত্রলীগের দায়িত্বে আছেন।

এসব কমিটির প্রায় প্রত্যেকটিতেই ছিল স্থানীয়দের ব্যাপক আধিপত্য। প্রতিটি কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নানা অপকর্মে যুক্ত হয়ে গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। রাজশাহীর বাইরের নেতাদেরকে বরাবরই কমিটিতে কোণঠাসা করে রাখা হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নেতা-কর্মীরা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় শিবিরের আধিপত্য ব্যাপক আকার ধারণ করে। তাছাড়া, রাজশাহী শহরেও বিএনপি-জামায়াতের আধিপত্য ছিল একটা সময়। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো পরিস্থিতি ছিল না। ২০১৩-১৪ সালেও একাধিকবার শিবিরের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। তবে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যাওয়া শুরু করে ২০১৬ সালের সম্মেলনের পর থেকে। ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকটাই কমে আসতে থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ছাত্রলীগ একক আধিপত্য নিয়েই ক্যাম্পাসে বিচরণ করছে।

শিবির-ছাত্রদলের প্রভাব কমে গেলেও, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা যে এই সময়ে বেড়েছে সেটা বলারও খুব একটা সুযোগ নেই। কমিটি না থাকায়, অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় ছিল রাবি ছাত্রলীগ। স্থানীয় নেতাদের আধিপত্য থাকায়, ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন  শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী। কেউ যুক্ত হয়েছেন ভর্তি জালিয়াতিতে, কেউ আবার আবাসিক হলগুলোতে লাগামহীনভাবে সিট বাণিজ্য করেছেন। লম্বা সময় জুড়ে সম্মেলন না হওয়ায় রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোটাই প্রায় ভেঙ্গে যায়।

এমতাবস্থায়, ২০১৯ সালে হল সম্মেলনের ঘোষণা দেয় কিবরিয়া-রুনু পরিষদ। যদিও, সেই সম্মেলনটি স্থগিত হয়ে যায় অজানা কারণে। নেতা-কর্মীরা এরপর থেকে নানা সময়ে শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনের দাবি করে আসছিল। 

তবে, ২০২২ সালের ১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে হল সম্মেলনের আয়োজন করে রাবি ছাত্রলীগ।বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলসহ ১৭টি আবাসিক হলের জন্যই কমিটি প্রদান করা হয়। এরপর থেকে, ক্যাম্পাসে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠে  ছাত্রলীগের রাজনীতি। শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনের দাবিও তখন বেশ জোরালো হয়ে উঠে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি জয়-লেখক দায়িত্বে থাকাকালেই সম্মেলনের ঘোষণা আসে ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর। তবে তুলনামূলক দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় এই ইউনিটের সম্মেলন ঠিক কোন কারণে স্থগিত হয়ে যায়—সেই প্রশ্নের সদ্যুত্তর দিতে পারেনি কেউই।

ছাত্রলীগের পদ প্রত্যাশী একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছাত্ররাজনীতি সম্ভব নয়। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য প্রয়োজন বিশাল কর্মী বাহিনী। এই ক্যাম্পাসে এখনকার সময়ে সেটা করা বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া, শাখা-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক প্রোফাইলও যথেষ্ট সমৃদ্ধ হচ্ছেনা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও রাবি ছাত্রলীগের তেমন গুরুত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা; যার ফলে নেতা-কর্মীরাও অনেকটা হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।

এদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য বলছেন, নিয়মিত সম্মেলনের  রেওয়াজ শুরু হলে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অংশগ্রহণ বাড়বে। তবে সেক্ষেত্রে, শুধু স্থানীয়রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে বরাবরই রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের একটা প্রকট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গুঞ্জন আছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি সাংগঠনিক ইউনিট হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতেই রাবি ছাত্রলীগের ভাগ্য নির্ধারিত থাকে। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সালের পর থেকে রাবি ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থানীয়দেরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রাজশাহীর বাইরে থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়াশুনা করতে আসে, সেই সাথে অনেকেরই স্বপ্ন থাকে ছাত্ররাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার। কিন্তু স্থানীয়দের দাপটে রাবি ছাত্রলীগ অনেকটাই রাজশাহী-কেন্দ্রিক; যার ফলশ্রুতিতে বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাবি ক্যাম্পাস থেকে তৈরি হয়নি কোনো জাতীয় নেতৃত্ব।

এসব বিষয়ে রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক 
আবু হোসাইন বিপু বলেন, "রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অন্য যেকোনো সাংগঠনিক ইউনিটগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। তবে বর্তমান ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই রাজধানী-কেন্দ্রিক হওয়ায়, এখানকার নেতা-কর্মীরা ফোকাসে থাকতে পারে না। সেন্ট্রালের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাটাও এখান থেকে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে আমি মনে করি, নিয়মিত সম্মেলনের চর্চাটা থাকলে, রাবি ছাত্রলীগ থেকেও দক্ষ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।"

স্থানীয় নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ার প্রসঙ্গে এক সময়ের আলোচিত এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, "কে স্থানীয়, আর কে বাইরের এই আলোচনাটাই আসা উচিত নয়। যাদের যোগ্যতা আছে, কর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা আছে—তাদেরকেই নেতা নির্বাচন করতে হবে। সেক্ষেত্রে কারও বাসা রাজশাহীতে হলেই সে বাড়তি সুবিধা পাবে; আর রাজশাহীর বাইরে হলে গুরুত্ব থাকবে না—এমনটা হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।"

রাবি ইউনিটের সাংগঠনিক স্থবিরতা ও নেতৃত্ব নির্বাচন প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, "রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ইউনিটকে শক্তিশালী করার জন্য এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের কাছে যারা গ্রহণযোগ্য; শিক্ষার্থীদেরকে সাথে নিয়ে একটি আধুনিক ও স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য যাদের দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ও স্বচ্ছ ইমেজ রয়েছে এবং যারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আপসহীন দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলবে—তারাই রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবে।"

অনিয়মিত সম্মেলনের প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এই সভাপতি জানান, "আমরা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করছি। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যেন নেতৃত্বজট তৈরি না হয়, নেতৃত্বের বিকাশ যেন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় এবং গতিময়তা থাকে; সেজন্য জেলা, মহানগর এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করা হবে।"


মন্তব্য