নতুনত্বের ছোঁয়ায় মল চত্বরে শোভা পাবে ঢাবির ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- লিটন ইসলাম, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:২০ PM , আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:২০ PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ও প্রশাসনিক ভবনের মাঝখানে অবস্থিত মল চত্বর এলাকা পেয়েছে নতুন রুপ।লাল রঙের কংক্রিটের মেঝের ওপর স্থাপিত নানা স্থাপনায় পেয়েছে অন্য রকম এক সৌন্দর্য। রাত হলে বাহারি সব বাতির আলোয় আলোকিত করেছে এর চারপাশ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন রুপে মল চত্বরের এই সৌন্দর্য এখন প্রায় দৃশ্যমান। যার মূল কাজ শেষ বাকি এখন চলছে ভুল-ত্রুটি বের করার যজ্ঞ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর স্মৃতি হিসেবে মল চত্বরে নির্মাণাধীন সেনটেনারি মনুমেন্টের (শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভ) কাজ প্রায় শেষ। এখন দিনরাত বিভিন্ন স্থাপনায় চলছে ঘষা-মাজা। সবুজ মাঠের পরিবর্তে বেশিরভাগ জায়গায় এখন বসেছে লাল রঙের কংক্রিটের মেঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনের অংশে সবুজায়নের জন্য লাগানো বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। তবে জল উদ্যানের কাজ এখনো অনেকটাই বাকি রয়েছে।
মল চত্বরের নতুন এই রুপ তৈরির পেছনে খরচ হচ্ছে ২১ কোটি টাকা। ৫৬টি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ‘নিন আর্কিটেক্টস’ সেনেটেনারি মনুমেন্টের নকশা প্রণয়ন করে। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর মনুমেন্ট তৈরির কাজের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। পরবর্তীতে তার মেয়াদ শেষ হলে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এই প্রকল্পটির হাল ধরেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
তবে সরকার থেকে বাজেট এখনো বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের কাজের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. আক্রাম হোসেন। তিনি বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সরকার ফান্ড রিলিজ করতে না পারায় প্রকল্পের কাজ সরকার আরো ছয় মাস বাড়িয়েছে।’
নতুনত্বে যা যা স্থান পেয়েছে
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মনুমেন্টের স্থাপত্য নকশায় একটি অসীম চিহ্নের অর্ধেক আকৃতির চিহ্ন করা হয়েছে যেখানে মুক্ত চিন্তা ও যুক্তির আসর বসবে। মনুমেন্টের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে ১০০টি বাতি যেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবান্বিত শতবছর, নবচেতনা, জ্ঞান, উদারনীতি, বিপ্লব, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, একতা এবং ত্যাগকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
মনুমেন্টের সামনে দক্ষিণের একটি ব্লকে চত্বরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ‘জল-উদ্যান’ নির্মাণ করা হয়েছে। জলাধারে পানির মান নিয়ন্ত্রণে দুই প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পরিশ্রবণ ট্যাঙ্ক নির্মাণাধীন। এ ছাড়া জলাধারের পানির উচ্চতা একই রাখার জন্য একটি ব্যাল্যান্স-ট্যাঙ্ক করা হবে। জল-উদ্যানে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পার্শ্ববর্তী কলাভবনের বিদ্যমান গভীর নলকূপের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। জলাধারের পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্যে ফোয়ারা, মাছ ও নির্দিষ্ট প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ব্যবহার করা হবে। ফোয়ারা, মাছ, নুড়িপাথর ও শাপলা ফুলের এই বৃত্তাকার স্থানটিকে ঘিরে বসার ব্যবস্থা থাকবে।
মনুমেন্টের মূল উপকরণ প্যালেট নির্মাণ করা হয়েছে যেকোন ধরনের আবহাওয়ায় সহনশীল স্টিল দিয়ে এবং এর সাথে মিল রেখে মনুমেন্টের বেদীতে ব্যবহার করা হয়েছে লাল কংক্রিট। লোহার পাতে তৈরি মনুমেন্টের মূল স্থাপনাটি (দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট, প্রস্থ ৩০ ফুট ও উচ্চতা ২৫ ফুট) সম্পূর্ণভাবে খোলামেলা রাখা হয়েছে যেন এটি প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারে। উইদারড স্টিল দ্বারা নির্মিত হওয়ায় এই কাঠামোটিতে নতুন করে জং ধরার সম্ভাবনা থাকবে না।
সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অল্প যত্নে টিকে থাকে এমন ১ হাজার নতুন দেশজ উদ্ভিদ রোপণের পরিকল্পনা রয়েছে। বৃক্ষ-গুললতা গুলো নির্বাচন করা হয়েছে, যেগুলো মূলত সৌন্দর্যবর্ধন করার কাজে ব্যবহার করা হয়। স্বল্প পরিচর্যায় যে গাছগুলো এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে কিন্তু সুন্দর এরকম গাছ রোপণ করা হবে। এখানে বিদ্যমান ৭০০ গাছ রয়েছে তার সাথে নতুন রোপণকৃত গাছগুলো মল চত্বরের শোভা বৃদ্ধি করবে।
মল চত্বরে জলনিষ্কাশন পদ্ধতি প্রাকৃতিক ঢাল তৈরির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে, যা চত্ত্বরসংলগ্ন বিদ্যমান ড্রেনেজ সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় ভ্যাডোস-জোন বর্ষা মৌসুমে অভিপৃক্ত থাকে, তদুপরি ঢাকাতে ‘রিচার্জ পিট’ এর ধারণা এখনও গবেষণা ও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। ফলে পানি পরিশ্রবণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সাথে আলোচনাক্রমে রিচার্জ পিট করার পরিবর্তে জল-উদ্যান সংলগ্ন পরিস্রাবণ ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শত বর্ষ ধরে যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে তার একটি সিগনেচার মল চত্বরে থাকছে। পাশাপাশি আগে মল চত্বর যেমন অনেকটা অপরিকল্পিত ছিলো সেটাকে এখন আমরা পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে এসেছি। এখানে ফুলের বাগান থাকবে। শিক্ষার্থীরা যত্রতত্র খেলাধুলা করে মল চত্বরের সৌন্দর্য নষ্ট করবে না। এখানে যা গাছপালা আছে আরো গাছপালা লাগানো হবে। বহু জায়গায় ঘাস নষ্ট হয়েছিল সেখানে ঘাস লাগানো হয়েছে। সর্বোপরি মল চত্বরকে একটি পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।
“পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এরিয়া যেভাবে সাজানো হয়, মল চত্বরকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সিগনেচার রেখে গড়ে তোলা হবে। আমাদের যে মনুমেন্ট আছে তার পাশে অনেকগুলো প্যানেল থাকবে সেখানে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা থাকবে। এখানে যারা আসবে এইসব প্যানেল দেখলেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে পারবে; বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারবে।”
মল চত্বরের দেখাশোনায় একটি টিম থাকবে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, মল চত্বর, এর গাছপালা ও মনুমেন্টকে সবসময় দেখেশুনে রাখার জন্য অর্থ্যাৎ এর ম্যানেজমেন্টের জন্য লোক অবশ্যই লাগবে এবং সেটা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।