দুর্যোগে শিক্ষার্থীদের করণীয় কি তা শেখাবে ঢাবির পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্লাব

ঢাবি
  © ফাইল ছবি

প্রতিবছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতি হয় দেশের বিপুল সম্পদ। এতে সাময়িক সময়ের জন্য স্থবির হয়ে যায় কোন কোন অঞ্চলের উন্নয়নের চাকা। দুর্যোগকালীন করণীয় সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেক সময় বিচলিত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। শুধু সাধারণ মানুষই নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই জানেন না কিভাবে দুর্যোগকালীন সময়ে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। গত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া ভূমিকম্পের মৃদু কম্পনে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী।  পরবর্তীতে নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হাতে নেয় এক নতুন উদ্যোগ। 

দুর্যোগের সময় শিক্ষার্থীদের করণীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ‘পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্লাব’ নামে প্রতিটি হলে একটি করে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে ইতিমধ্যেই নীতিমালা তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আগামী এপ্রিল মাস থেকে এই ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হবে এই উদ্যোগের।


ক্লাবের গঠনতন্ত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শিক্ষার্থীরা যেন অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগে আতঙ্কগ্রস্ত না হয় এবং দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা শিক্ষাজীবন থেকেই রাখতে পারে; সেজন্য এই ক্লাবের মাধ্যম তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এর মাধ্যমে দুর্যোগে ও এর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবন থেকে নিজেদের দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য গড়ে তুলতে পারবে। 

হলের প্রতিটি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিশ্চিত করবে এই ক্লাব। পাশাপাশি এই ক্লাবের মাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করবে শিক্ষার্থীরা। আগামী মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও হোস্টেলগুলোতে এই ক্লাবের কার্যক্রম শুরু হবে। ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিটি হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি এবং হলের ৩ জন আবাসিক শিক্ষক ও হল প্রাধ্যক্ষের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকবেন প্রতিটি হলের প্রাধ্যক্ষ।

এই ক্লাবের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা; যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় হলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করা; পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুর্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সেমিনার আয়োজন করা; পরিবেশ সচেতনতায় জাতীয় দিবসসমূহ পালন করা; নিয়মিত ‘ক্লিন ক্যাম্পাস’ কার্যক্রম পরিচালনা; ডাস্টবিন ব্যবহারে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছর প্রতিটি হল থেকে একজন শিক্ষার্থীকে প্রশংসাপত্র প্রদান করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।


এ প্রসঙ্গে নীতিমালা প্রণয় কমিটি ও প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, ইতোমধ্যে অনেক হলেই আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। আশা করছি ঈদের পরেই এর কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।

“এখানে মূল কাজটা করবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এই ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ও দুর্যোগে ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের সচেতন করে গড়ে তোলা। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দুর্যোগে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষিত না। ধীরে ধীরে সব শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আমাদের গঠনতন্ত্রে এসব কিছু উল্লেখ করা আছে,” যোগ করেন অধ্যাপক মামুন।

শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ থাকবে এক বছর। প্রতি দুই মাস অন্তর একটি করে সভা করতে হবে। সভায় ক্লাবের নীতিমালায় উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এই কমিটিতে ১ জন সভাপতি, ২ জন সহ-সভাপতি, ১ জন সাধারণ সম্পাদক,  ২ জন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ১ জন দপ্তর সম্পাদক, ১ জন অর্থ সম্পাদক, ১ জন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও ৬ জন নির্বাহী সদস্য থাকবেন; যাদের সবাই হবেন ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

এদিকে এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন হলের দায়িত্বরত প্রাধ্যক্ষরা। তাদের মতে, পরিবেশ নিয়ে ক্যাম্পাসে অনেকেই কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া দুর্যোগে শিক্ষার্থীদের করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, “এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় পাওয়া। শিক্ষার্থীরা তাদের বাস্তব জীবনে এর জ্ঞান ও দক্ষতাকে ঠিকভাবে কাজে লাগানোর পাশাপাশি তাদের নিজেদের এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝেও এই জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে পারবে। এতে করে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে না, পুরো দেশ উপকৃত হবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভিত আরও মজবুত হবে।মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল ও উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলেন, এই উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। আমাদের ক্যাম্পাসেই প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যা বিদ্যমান। ক্যাম্পাসে অতিমাত্রায় বায়ু দূষণ ও পলিথিন ও আবর্জনার ব্যবহার দেখা যায় যত্রতত্র। এছাড়াও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও এক্টিভিজমের জায়গায় বড় ধরনের একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করতে প্রত্যেক হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্লাব অন্যতম একটি প্লাটফর্ম হবে আশা করি। 

ইমরান মনে করেন, যারা তরুণ জলবায়ু কর্মী হিসেবে বৈশ্বিক সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করে তাদের অভিজ্ঞতা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ। শিক্ষার্থীদের মাঝে যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বা পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে বিভিন্ন কর্মপন্থা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে সেটি সে তার নিজস্ব এলাকায় কাজে লাগানোর পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়েও অবদান রাখতে পারবে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচির সাথে ঢাবি শিক্ষার্থীরা আরও গভীরভাবে আন্ত:সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে‌ বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।


সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, এই ক্লাবের লক্ষ্য হবে স্ব স্ব বিভাগ, ইনস্টিটিউট কিংবা হলের ক্যাম্পাসকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। বিগত ভূমিকম্পে দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থী হলের দুই-তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছে, পা ভেঙ্গেছে; এই বিষয়গুলোতে তাদেরকে সচেতন করা। শিক্ষার্থীরা যেন অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়। তারা যেন দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা শিক্ষাজীবন থেকেই রাখতে পারে। সেজন্য এই ক্লাবের মাধ্যম তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এর মাধ্যমে দুর্যোগে ও এর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে। 

“এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবন থেকে নিজেদের দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য গড়ে তুলতে পারবে। হলের প্রতিটি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিশ্চিত করবে এই ক্লাব। পাশাপাশি এই ক্লাবের মাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করবে শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে,” যোগ করেন উপাচার্য।

সামনে হলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেও পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও জানান অধ্যাপক মাকসুদ কামাল।


মন্তব্য