গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হওয়ার হুমকি দেন ইডেনের ‘সমন্বয়ক’

সমন্বয়ক
  © সংগৃহীত

গভীর রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি, ব্যক্তিগত ফোন চেক করা, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোসহ নানা অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক’ দাবি করা এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। আর এসব কাজে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে ওই কলেজের এক সহকারী হোস্টেল সুপারের বিরুদ্ধেও।

সমন্বয়ক দাবি করা ওই শিক্ষার্থীর নাম মরিয়ম মারাম। তিনি বাংলা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ ও খোদেজা খাতুন ছাত্রীনিবাসের আবাসিক শিক্ষার্থী।

জানা যায়, ইডেন কলেজের খোদেজা খাতুন হলের ৩১০ , ৩১২ ও ৩১৪ নাম্বার কক্ষগুলো আগে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল যেগুলোকে বলা হতো ‘রাজনৈতিক রুম’। সেসব কক্ষে যারা থাকতেন তাদের বেশিরভাগই বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে। এই সুযোগকেই পুঁজি করে মরিয়ম নামের অভিযুক্ত শিক্ষার্থী নিজেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে হলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে প্রভাব বিস্তার করেন। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তিন রুমে (৩১০, ৩১২ ও ৩১৪) অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের জোর করে সহকারী হল সুপার মোস্তারি সালেহিনের কক্ষে নিয়ে যায় মরিয়মসহ আরও কয়েকজন। সেখানে নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, ফোন চেক করা হয়। ব্যক্তিগত বিভিন্ন ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয়। সিনিয়র, জুনিয়র সকল শিক্ষার্থীকে মাফ চাইতে বাধ্য করা হয়। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থীই কান্না করে ফেলেন। এমনকি আজ বুধবারের মধ্যে ওই তিন কক্ষের শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়। আর এসব সবকিছু হয় হল সুপার মোস্তারি সালেহিন এর সামনে। যদিও তিনি এসব কাজে সম্মতি দিয়েছেন বলে জানা যায়।


এ বিষয়ে তিনজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের কিন্তু কেউই ভয়ে নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক হয়নি। এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, “মরিয়মের কাছে ম্যামের সামনে (হল সুপার মোস্তারি) সিনিয়র, জুনিয়র সবাইকে মাফ চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি ম্যাম আজকের মধ্যে সব মেয়েকে হল থেকে বের হতে বলেছে। ম্যাম বলেছে যারা পলিটিক্যাল রুমে ফ্রি তে থাকে তারা প্রতিরাতে ছাত্রলীগের নেতাদের রুমে গিয়ে সার্ভিস দেয়। তার কিছুক্ষণ পর সবাই যখন রুমে ফিরেছে তখন মরিয়ম চিল্লাপাল্লা করছে আর বলছে সব মেয়েরা রুম থেকে বের হয়ে যা। কে আমার নামে অভিযোগ যানাইছিস। আসল কল কাঠি সেই নাড়াচ্ছে। মেয়েদের কাছে বলছে তোমাদের হয়ে কথা বলছি। আবার ম্যামদের বলেছে আমরা লিগ্যাল হওয়ার জন্য যারা ফরম জমা দিয়েছি তাদের যেনো ভাইভা থেকে বাদ দেওয়া হয়। একদিন সে বলছে সব টিচাররা আমাকে ফোন দেয়। এখন প্রিন্সিপালও ফোন দিয়ে বলে তাকে যেন পদত্যাগ করানো না হয়।”


আরেক ভুক্তভোগী বলেন, “আমাদের মোবাইল চেক করেছে খুব বাজে ভাবে মোস্তারি ম্যামের সামনে তিনি কিছুই বলেননি। মোবাইল চেক করে যখন কিছুই পায়নি তখন অন্য দোষ দেওয়া শুরু করেছে। এখানে মরিয়মসহ আরো কিছু লিগ্যাল মেয়ে সমন্বয়ক সেজে আমাদের মতো সাধারন মেয়েদের এতো হেনস্তা করেছে সবাই মিলে আমরা সবার সামনে কাঁদতে বাধ্য হয়েছি; আর এই কান্না নিয়েও তারা হাসাহাসি করেছে ৷ আমরা সাধারন মেয়ে লিগ্যাল সিট না  পেয়ে  পলিটিক্যাল রুমে উঠেছিলাম আমরা কোনো রকম কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না কিন্তু কিছু মেয়ে একসাথে হয়ে আমাদের হল ছাড়তে বাধ্য করছে, জোর করছে এর সাথে মোস্তারি ম্যম ও জড়িত।”

তবে এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী মরিয়ম মারাম দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, “আমি কখনো সমন্বয়ক পরিচয় দেইনি। এসব মিথ্যা অভিযোগ।”

শিক্ষার্থীদের ফোন চেক করার বিষয়ে তিনি বলেন, “কারও ফোন চেক করিনি। হলে যেসব মেয়ে থাকে কারও সাথে আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ নাই।”

এসময় সমন্বয়ক দাবি করা মরিয়ম এই প্রতিবেদককে নিউজ প্রকাশ করা হলে হুমকি প্রদান করেন। তিনি বলেন, “নিউজ করার আগে যথেষ্ট প্রমাণ নিবেন না হলে কিন্তু আপনারাও ফেঁসে যাবেন।”

এদিকে অভিযোগ উঠেছে পূর্বে ছাত্রলীগ নেত্রীদের আশ্রয় দেয়া সহকারী হল সুপার মুস্তারি সালেহিন এখন নিজের পদ ধরে রাখার জন্য সমন্বয়ক দাবি করা শিক্ষার্থীদের হাত করে রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে থাকা শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন, নানা ভাবে ‘হেনস্থা’ করছেন। রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। এমনকি এসব কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের আজ বুধবার হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন তিনি।

ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “নেত্রীদের ভয়ে বাধ্য হয়ে সবারই প্রোগ্রাম করা লাগে। তার মানে এটা নয় যে সবাই রাজনীতির সাথে জড়িত। ইডেনের যতগুলো হল আছে সবগুলো হলে নেত্রীদের রুমই বেশি। এ ব্যাপারে কলেজ প্রশাসন সর্বদা নিশ্চুপ ছিল। এমনকি এতো দিন তারা নেত্রীদের আনুগত্য করেছে। তাদের পক্ষ হয়ে স্টুডেন্টদের সাথে অন্যায় করেছে। কিছু কিছু শিক্ষক আন্দোলনকারীদের বিদ্রুপ করছে। এখন আন্দোলনের পর যখন স্বৈরাচার পতন হলো, ছাত্রলীগের কোনো অস্তিত্ব নেই তখন কিছু ম্যাম সমন্বয়ক দাবি করা মেয়েদের পক্ষ হয়ে সেই একই অবিচার করছে আমাদের সাথে।”

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হল সুপার মুস্তারি সালেহিন দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টসকে বলেন, যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো প্রশাসনিকভাবে করা হয়েছে এবং কেউ বের হয়ে যেতে বললেই আমাদের ছাত্রীরা বের হয়ে যাবে না। অভিযোগগুলো শুনবো, পর্যালোচনা করবো তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে যেসব শিক্ষার্থী থাকেন তাদেরকে নেতাদের রুমে পাঠানো হয় এমনটি আপনি বলেছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুস্তারি সালেহিন বলেন, “হলে আসেন। আপনার সাথে সামনাসামনি কথা বলবো।”


এদিকে হঠাৎ হল প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন হলটির রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে থাকা বিশের অধিক শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, বাধ্য হয়ে রাজনৈতিক প্রোগ্রাম করানো হয়েছে কিন্তু পরে কোটা আন্দোলনে থেকেও আমাদের হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশনা অমানবিক ও শিক্ষার্থী বিরোধী। 


হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, “বৈধভাবে সিট না পেয়ে মেয়েরা বাধ্য হয়ে নেত্রীদের মাধ্যমে হলে ওঠে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। খুবই সাধারণ পরিবার থেকেও মেয়েরা এখানে পড়তে আসে নিজেকে উন্নত করার একবুক স্বপ্ন নিয়ে। হল সুবিধার জন্যই মূলত অনেক মেয়ে ইডেনকে বেছে নেয়। কারণ সবার বাইরে থাকার সামর্থ্য নেই। তো যখন ভর্তির পর হলের লিগ্যাল সিটের জন্য ম্যামদের কাছে যাওয়া হয় তারা অনেক বাজে ভাবে অপমান করে মেয়েদের। বলে সামর্থ্য নেই তাহলে এখানে পড়তে কেন এসেছো। বাড়ির পাশের কলেজে ভর্তি হতে পারো নি। কিন্তু হল প্রশাসনের এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমরা এখন যাবো কোথায়?”