ঢাবির হল থেকে সেই রনির নির্দেশে বাইক চুরির অভিযোগ

রনি
  © ফাইল ছবি

রেলওয়ে থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ উঠেছে, এ ঘটনায় নির্দেশের অভিযোগ উঠেছে রনির দিকে। 

অভিযোগ উঠেছে, হল থেকে বের করা এসব বাইকের একটি বিক্রি করে ফেলা হয়েছে আর কয়েকটি বাইকের চাবি পরিবর্তন করে তার ছোট ভাইদের ব্যবহারের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছেন রনি।

একজন শিক্ষার্থী এসবের কারণ জানতে চাইলে দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস-এর হাতে আসা একটি অডিওতে মহিউদ্দিন রনিকে বলতে শোনা যায়, তোদের জন্যই এসব করা হচ্ছে।

তবে ঠিক কয়টি বাইক হল থেকে বের করা হয়েছে, কতটি বিক্রি করা হয়েছে আর কয়টি অনুসারীদের দিয়েছে সেই সংখ্যা জানা যায়নি।

তবে তিনটি বাইকের সুনির্দিষ্ট তথ্য দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস-এর হাতে এসেছে। এর মধ্যে দুইটি বাইক বের করা হয়েছে হলের পিছনের গেইট দিয়ে যেখানে কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি বাইক বের করা হয়েছে হলের সামনের গেইট দিয়ে।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পরদিন ৬ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিকহলসমূহ খুলে দেওয়া হয়। সেদিন থেকেই বাইক সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাগুলো ঘটছে। হলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বলছেন, ৫ আগস্ট বা এর আগে দেখা গেছে এরকম আরও কিছু বাইক তারা বর্তমানে দেখছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেলো কোটা সংস্কার আন্দোলনে মহিউদ্দিন রনি সমন্বয়ক বা সহ সমন্বয়কের কোন পদে ছিলেন না। তবে আন্দোলনে সক্রিয় উপস্থিতি ছিলো তার ।আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে রনির নেতৃত্বেই শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা যোগ দিতেন। ৬ আগস্ট হল খোলার পর তিনি শিক্ষার্থীদের খাওয়াইয়ে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টাকা দিয়ে হলে আধিপত্য বিস্তার শুরুর চেষ্টা করেন।

 প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা:

বাইক বের করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলের এক শিক্ষার্থীর বর্ণনায় উঠে আসে মহিউদ্দিন রনি কীভাবে এই কার্যক্রমে যুক্ত। তিনি তার দাবির পক্ষে বিভিন্ন অডিও এবং ভিডিও দেখান যেগুলোর মাধ্যমে রনির সরাসরি যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী বলেন, গত ৭ আগস্ট রাতে আমিসহ কয়েকজন জহু হলের বাস্কেটবল মাঠের দিকে ছিলাম। তখন দেখি দুইটা বাইক কয়েকজন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। কারা কেন নিয়ে যাচ্ছে দেখতে গিয়ে দেখি হলের দুই ভাই এগুলো নিচ্ছেন। বাইকগুলো কার বা কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন, রনি ভাই (মহিউদ্দিন রনি) নিয়ে যেতে বলেছে।

এই শিক্ষার্থী বলেন, তখন আমি মহিউদ্দিন রনিকে ফোন দিলে তিনি বলেন, তোদের জন্যই এগুলো করা হচ্ছে।

আমি 'দরকার নেই' বলে বাইকগুলো না নিয়ে যেতে বললে রনি ভাই বলেন, আমি হলে এসে কথা বলছি। 

হলে এসে রনি আমাকে বলেন, তোরা জুনিয়র। এতো বেশি বুঝিস কেন। হলে যারা শৃঙ্খলা কমিটিতে থাকবে তারা এগুলো চালাবে। দরকার হলে তুইও এদের সাথে যা। 

তখন দোকান চিনে আসতে আমিও তাদের সাথে যাই। দোকানটার অবস্থান বকশিবাজার মোড়ে। সেই দোকানে গিয়ে দোকানদারকে রনি ভাই পাঠাইছে বলার পর তারা বাইকগুলো রেখে দেয়।

এই শিক্ষার্থী অভিযোগ করে আরও বলেন, ঐদিন রাত বারোটার সময় এই গ্রুপটা আরও একটা বাইক বের করার চেষ্টা করে হলের পিছনের গেইট দিয়ে। তখন আমরা বাঁধা দিলে বাইকটা আর বের করেনি তারা। তবে মুছে ফ্রেশ করে হল করিডোরে রেখেছে। পরে দেখি, বাইকটা হলে আর নেই। গেইটের দারোয়ানদের জিজ্ঞেস করলে বলে, রাইয়ান নামে একজন বের করে নিয়ে গেছে।

এই শিক্ষার্থী বলেন, এই ঘটনার কিছুদিন পর রনি ভাইকে আবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ভাই বাইক কই? আপনারা না শৃঙ্খলা কমিটির জন্য বাইক আনছেন? 

তখন তিনি বলেন, আসবে আসবে। এতো প্যারা নিসনা। এগুলো ঠিক করতেছে এখনো।

উনার কথায় সন্দেহ হলে আমরা সেই দোকানে গিয়ে জানতে পারি, বাইক অলরেডি একটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আরেকটার কাজ চলছে।

আরও দুইদিন পর রনি ভাইয়ের সাথে কথা বললে তিনি জানান, বাইকগুলো দোকানেই আছে। আর একটা বাইক নাকি কে বিক্রি করে ফেলেছে। এরপর থেকে রনি ভাই আমার ফোন ধরেননা আর দেখলে এড়িয়ে চলেন।

 দোকানির বক্তব্য: 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী বকশিবাজার মোড়ের সেই দোকানে গিয়ে দোকানদারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, রনি ভাই একদিন একটা বাইক ঠিক করতে নিয়ে এসে বলে যায় কয়েকটা বাইক আসবে। এগুলো ঠিক করে রাখিয়েন। এরপর উনার নামে এখানে আরও একটা বাইক আনা হয়েছে। সেখানের একটাতে গাড়ির লকসহ কয়েকটা পার্টস লাগানো হয়েছে আরেকটাতে ব্যাটারিসহ আরও কয়েকটি সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়েছে।  

তিনি বলেন, একদিন রনি ভাই এর সাথে আরও তিনজন একটা বাইকে করে দোকানে আসে । যেটাতে লক পরিবর্তন করেছি সেই বাইকটা রনি ভাই তাদের হাতে তুলে দিলে তারা বাইকটা নিয়ে যায়। আর রনি ভাই হেঁটে চলে যায়। আর অন্য বাইকটি মেহেদী (জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান) নামে একজন নিয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীর বক্তব্য:

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের আরও এক শিক্ষার্থী বলেন, গত ১৭ জুলাই যখন সব হল বন্ধ ঘোষণা করা হয় সেদিন রাতে আমিই হল থেকে সর্বশেষ বের হই। বের হওয়ার সময় আব্বাসী ভাইয়ের (সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত) রুমের সামনে উনারা বাইকের চাবি পড়ে থাকতে দেখে সেটা নিয়ে নিজের কাছে রাখি। হল থেকে বের হওয়ার সময় আব্বাসী ভাইয়ের বাইকটাসহ হলের গ্যারেজে এতো পরিমাণ বাইক ছিলো যেগুলো ৭ আগস্ট হলে এসে আমি আর দেখিনাই। 

তিনি বলেন, পাঁচ তারিখের পর যে সিচুয়েশনে সেই সময়ে উনারা যে হলে এসে বাইক নিয়ে যাবে সেরকম পরিস্থিতি  ছিলো না। সুতরাং বুঝা যায়, তৃতীয় কোন পক্ষ এগুলো সরিয়েছে।

 নিরাপত্তাকর্মীদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বের করা হচ্ছে বাইক:

হলের মূল ফটকে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুইটি বাইক বের করার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে কথা বলেছেন হলের কর্মচারীরা।

একজন কর্মচারী বলেন, গত ১৪ তারিখ সকালে হলেরই এক শিক্ষার্থী আমাকে এসে বলেন, বাসেত ভাই আমার এলাকার। উনার বাইকের চাবি আমার কাছে দিয়েছে। আমি উনার বাইকটা নিয়ে যাবো। 

আমি ওনাকে বলি, ওকে, চাবি থাকলে নিয়ে যান। পরে এই শিক্ষার্থী হলের পিছন গেইট দিয়ে একটা বাইক নিয়ে যায়। তবে কীভাবে নিয়েছে সেটা আমি দেখিনি। পরে শুনি, এটা বাসেত ভাইয়ের বাইক না, নুর ভাইয়ের বাইক।

এই বিষয়ে ইমাম বাসেত বলেন, আমি আমার বাইক ১৭ তারিখ নিয়ে এসেছি। সুতরাং আমার বাইক কাউকে নেওয়ার কথা বলার প্রশ্ন আসে না। 

হলের আরেকজন কর্মচারী বলেন, গত ১৮ তারিখ দুইজন হলের শিক্ষার্থী একটা বাইক ঠেলে ঠেলে মেইন গেইট দিয়ে বের করছে। সেসময় তাদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেছে, এটা তাদেরই বাইক। অনেকদিন পরে থাকায় ইঞ্জিন কাজ করছে না তাই এভাবে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে এটা উনারা চালাচ্ছেন। পরে শুনি সেটা ছাত্রলীগ নেতা আব্বাসি ভাইয়ের (সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত) বাইক।


মহিউদ্দিন রনির বক্তব্য

মহিউদ্দিন রনি বলেন, “আমার কোন অনুসারী নেই। আমি একটুকু বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের যেসকল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের গায়ে হাত দিয়েছে তাদের দুইটা বাইক শিক্ষার্থীরা জব্দ করেছে। আমি বলেছি এই বাইকগুলোর মালিক এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং তারা এগুলো মেরামত করে এখন ব্যবহার করছে।”

একটি বাইক বিক্রি করা হয়েছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি জানি না।’

হল প্রাধ্যক্ষ ছিলো না কিন্তু হাউজ টিউটররা হলে ছিলো তাদেরকে জানানো হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, ‘হাউজ টিউটররা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে নাই। তাদের কোন ভূমিকা ছিলো না সেসময়।’

নৈতিক দিক দিয়ে আপনি এই বিষয়কে কিভাবে দেখেন- এই বিষয়ে রনি বলেন, “তারা যদি কোনভাবে বলে যে আমরা বাইকটা চাচ্ছি , যদি কমিটমেন্ট দেয় আমরা কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবো না তাহলে নৈতিক জায়গা থেকে তাকে বলবো ঠিক আছে বাইকটা নিয়ে আপনি চলে যান; আর কখনো যদি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত না হন।”

তাহলে বাইক নেয়া হয়েছে এটা সত্য- এটা রনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘হ্যা এটা সত্য দুইটা বাইক নেয়া হয়েছে। আর একটার বিষয়ে আমি জানি না।’

আপনি তাহলে এটা নির্দেশ দিয়েছেন - এ প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, ‘হ্যা হ্যা আমি নির্দেশ দিয়েছি এটা সত্য।’