ঢাবি শিক্ষকের কলাম

বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ার চ্যালেঞ্জ, প্রতিকারের নানা উপায় 

ঢাবি
  © সংগৃহীত

প্রতিবছর ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘ডিমেনশিয়া নিয়ে কাজ করার এখনই সময়, আলঝেইমার্সের ওপর কাজ করার এখনই সময়’। ডিমেনশিয়া একটি নিউরো-প্রগতিশীল অবস্থা, যা আলঝেইমার্সসহ অন্যান্য রোগ দ্বারা সৃষ্ট। আলঝেইমার্স হলো ডিমেনশিয়ার সর্বাধিক সাধারণ রূপ এবং এটি প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ ডিমেনশিয়া ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ১৯০৬ সালে অ্যালোইস আলঝেইমার নামে এক জার্মান চিকিৎসক প্রথম এ ধরনের অসুস্থতার প্রকৃতি নির্ণয় করেছিলেন। ডিমেনশিয়ার লক্ষণের মধ্যে রয়েছে–মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের অবনতি, জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপের অবনতি, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, যোগাযোগ হ্রাস এবং সময়, স্থান ও ব্যক্তিতে বিভ্রান্ত বোধ করা। মস্তিষ্ক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলো আরও খারাপ হয়। যদিও অসুস্থতার প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব হতে পারে, লক্ষণগুলোর ক্রমবর্ধমান তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। অসুস্থতার শেষ পর্যায়টি সম্পূর্ণ নির্ভরতা এবং জটিল উপশমকারী যত্নের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে যুক্ত। 

এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন যৌক্তিকভাবে আসে, সেটা হলো, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কী চান? অল্প কথায়, মানবাধিকার। কোনো নাগরিকের চেয়ে বেশি নয় এবং অবশ্যই কমও নয়। এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত, অসুস্থতার প্রভাব ছাড়াও ডিমেনশিয়া নিয়ে বসবাসকারী ব্যক্তি এবং পরিবারের সদস্যরা তাদের অধিকার পূরণের জন্য সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আইনত ও অর্থনৈতিক বাধার মুখোমুখি হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অনেক দেশে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি পরিষেবাগুলোতে ন্যায়সংগত প্রবেশ এবং সমাজে ডিমেনশিয়া যত্নের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। 

বিশ্বে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন নতুনভাবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্যের উদ্বেগ হিসেবে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ৫০ মিলিয়নেরও বেশি লোক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। আলঝেইমার্স ডিজিজ ইন্টারন্যাশনালের ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ কোটি ২০ লাখে, যা প্রায় রাশিয়া বা বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান। আলঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন, যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৮ লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ২১ লাখ ৯১ হাজারে উন্নীত হবে। 

বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বয়স বৃদ্ধি, নিম্ন শিক্ষা, অপুষ্টি এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনিয়মিত অংশগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা খুবই কম এবং ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রায়ই নির্ণয় করা যায় না। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পায় না। অধিকন্তু, বাংলাদেশে ডিমেনশিয়াকে বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটি অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সহায়তা পাওয়া কঠিন এবং একটি দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডিমেনশিয়া কর্মী বাহিনীর জন্য ক্রমবর্ধমান আহ্বান রয়েছে। এটি স্বীকৃত যে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, নার্স, অনুশীলনকারী, পরিবারের সদস্য এবং যত্নশীল সবারই ডিমেনশিয়া সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যাই হোক, বর্তমানে ডিমেনশিয়া যত্ন নীতির অনুপস্থিতি এবং কর্মশক্তি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতির অভাব রয়েছে; এবং ডিমেনশিয়া যত্নকে এখনও দেশের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত ও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। যদিও আমাদের কিছু জাতীয় নীতি ও আইন প্রবীণদের কল্যাণে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সমাজকল্যাণ নীতি ২০০৫, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১, বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২, জাতীয় প্রবীণ নীতি ২০১৩, পিতা-মাতা রক্ষণাবেক্ষণ আইন, ২০১৩ এবং বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮।  তবে বর্তমানে ডিমেনশিয়া সম্পর্কিত নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং ডিমেনশিয়া যত্ন নীতি এবং পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যান্য নাগরিকদের পাশাপাশি প্রবীণদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ সরকার বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হিসেবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সব বয়সের সবার জন্য সুস্থ জীবন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৩ ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ নির্ধারণ করে। ডিমেনশিয়ার আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি, তাদের পরিবার, ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় পরিষেবা প্রদানে জাতীয় ডিমেনশিয়া কেয়ার এবং কর্মশক্তি উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা তাদের নিজস্ব ডিমেনশিয়া কেয়ার পলিসি বিকাশের জন্য অন্যান্য দেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। তাই নতুন নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি বিদ্যমান নীতি, প্রতিষ্ঠান ও আর্থসামাজিক কাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত প্রবীণদের জন্য সার্বিক সহায়তা ও পরিচর্যা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নীতি পরিকল্পনাকারী এবং যারা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন, তাদের অবশ্যই ডিমেনশিয়া আক্রান্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং উপলব্ধ সুবিধার জটিল আন্তঃসম্পর্কগুলো বুঝতে হবে। অধিকন্তু, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, অনুশীলনকারী, যত্নশীল ও ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করা পরিবারের সদস্যদের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা পরিচালনার জন্য সরকারকে ব্যাপক ও সমন্বিত কর্মশক্তি বিকাশের পদ্ধতির ওপরও কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ার বর্তমান অভিজ্ঞতা ও ব্যাপকতার ওপর ভিত্তি করে ডিমেনশিয়া সেবার জন্য সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজের সদস্য, কমিউনিটির লোকজন এবং পরিবারের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণে নিম্নোক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে: ১. জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার হিসেবে ডিমেনশিয়া যত্নের স্বীকৃতি;
২. ডিমেনশিয়াবান্ধব কমিউনিটি সৃষ্টির লক্ষ্যে ডিমেনশিয়া সেবা ও তাদের অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা ও শিক্ষার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ;
৩. ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের পরিচর্যাকারীদের জন্য আরও ভালো যত্ন এবং সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সেবা প্রবর্তন করা;
৪. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের যত্নশীলদের জন্য বাড়িতে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ;  
৫. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আবাসিক/প্রাতিষ্ঠানিক যত্ন চালু করা এবং স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার এবং যত্নশীলদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু করা; এবং  
৬. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জ্ঞানভিত্তিক ডিমেনশিয়া সেবা উদ্ভাবন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিমেনশিয়া বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ।

ড. মুহাম্মদ মাইনউদ্দিন মোল্লা: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়