ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে ঢাবি প্রশাসনের মতবিনিময়, যা বললেন ছাত্রনেতারা

ঢাবি
  © ফাইল ছবি

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন ঘোষণা দেয়ার পর দেশব্যাপী শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন।

অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) ক্যাম্পাসের এগারোটি ছাত্রসংগঠনকে আমন্ত্রণ জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপাচার্য লাউঞ্জে হওয়া এই সভায় অংশগ্রহণ করে  ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ (ইশা), ছাত্র ইউনিয়নসহ আরও কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ।

জানা যায়, সভায় উপস্থিত সকল ছাত্রসংগঠন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দেয়। সবার দাবি, ছাত্ররাজনীতি সংস্কারের পক্ষে। এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সবাই তাদের মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারে, এক্ষেত্রে কাউকে ট্যাগ দেয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। সভায় ছাত্রসংগঠনগুলোর দেয়া নানা প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করে একটি সংকলন করা হবে।

এছাড়া সভায় একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হয়, বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হবে এবং এই কমিশনের মাধ্যমে ঠিক করা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেমন হবে, পাঠদান পদ্ধতি কেমন হবে, রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে কাজ করবে, কিভাবে করতে পারবে কিংবা পারবে না এসব বিষয়ে রুপরেখা প্রদান করা হবে।

ছাত্রদলের বক্তব্য:

ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, আমরা নিজেদের সংগঠনের জন্য আলাদা কোন দাবি রাখিনি। প্রাথমিক কিছু কনসার্নের কথা বলে এসেছি। সেখানে হল ও ক্যাম্পাসে নির্যাতনমুখী ছাত্র রাজনীতির বিলোপের স্বার্থে গণরুম, গেস্টরুম, র‍্যাগিং কালচার বন্ধ করে মোটাদাগে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং জুলাই গণহত্যায় জড়িত ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিচারপূর্বক ফ্যাসিবাদী ঢাবি সিন্ডিকেট বাতিল করে পুনর্গঠন করাসহ আমরা নিচের ব্যাপারগুলো তুলে ধরেছি। 

সর্বোপরি ছাত্ররাজনীতির চর্চার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সৃষ্টিরও আগে থেকে এই ভূখন্ডের গণমানুষের দাবি আদায়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সদ্যগত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল কারিগর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বন্ধের যে চিন্তা তাকে আমরা ফ্যাসিবাদী ভাবধারার অংশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করি- মাননীয় ভিসি স্যারকে আমরা সেটা জানিয়ে এসেছি।

এছাড়াও আমাদের আলোচনায় তীব্র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের মানসিক ট্রমা কাটানোর উদ্যোগ, সুস্থধারার আধুনিক ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা প্রণয়ন, সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির অনুপস্থিতিতে নিষিদ্ধ ও গোপন সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধির উদ্বেগ- ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে।

শিবিরের বক্তব্য:

ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, আমরা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই না, যৌক্তিক সংস্কার চাই। গত পনের বছর ধরে আমরা যে ছাত্র রাজনীতি দেখেছি সেটা ছিলো দাসত্বের রাজনীতি চাই না, আমরা চাই মেধার রাজনীতি, যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথাগুলো থাকবে, সবাই তার মত প্রকাশ করতে পারবে এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অধিকার ফিরে পাবে। এক্ষেত্রে মতের ভিন্নতার কারণে কাউকে ট্যাগিং দেয়া হবে না,‌ নির্যাতন নিষ্পেষণ করা হবে না, সবাই তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাবে এবং কারও রাজনৈতিক আদর্শ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।

ছাত্ররাজনীতিতে আপনারা কেমন সংস্কার চান - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা একটা পলিসি ডায়লগ এর আয়োজন করার কথা বলেছি যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ছাত্র প্রতিনিধি থাকবে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের সংস্কারের প্রস্তাবনাগুলো পেশ করতে পারে। পাশাপাশি আমরা পরিচিত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিয়ে দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম ও গেস্ট রুম প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছি। শিক্ষার্থীদের জন্য সিটের যে বন্দোবস্ত হয়েছে সেটা যেন জারি থাকে এ বিষয়ে আমরা ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।

বর্তমানে সিন্ডিকেটে যারা আছে তাদেরকে অপসারণ করে নতুন সিন্ডিকেট গঠনের পাশাপাশি জুলাইয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায় শিবির।

ছাত্রফ্রন্টের (একাংশ) বক্তব্য: 

ছাত্রফ্রন্ট ঢাবি শাখার দুইটি অংশই সভায় উপস্থিত ছিলো। এর মধ্যে এক অংশের সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সাদিক বলেন , আমরা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব বন্ধ করতে প্রথম বর্ষ থেকে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে সিট বন্টন এবং জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে নেওয়া বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। আমরা অবিলম্বে পরিবেশ পরিষদের মিটিং আহ্বান এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছি। ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার নির্দেশদাতা সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে মিটিং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছি। এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে নতুন সিন্ডিকেট গঠনের দাবি জানিয়েছি। শত মানুষের শহীদি আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তা রূপায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরও কার্যকরী ভূমিকা এবং সচেতন পদক্ষেপ নিবে বলেই আমরা প্রত্যাশা জানিয়েছি।’

ছাত্র ফেডারেশনের বক্তব্য:

ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আরমানুল হক বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশের অংশ হিসেবে ছাত্র রাজনীতিরও কাঠামোগত সংস্কার চাই। রাজনীতি বন্ধ মানে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়সংগত ভাবে সংগঠিত হবার অধিকারকে হরণ করা। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে আমরা আর ফ্যাসিবাদি ব্যাবস্থায় ফিরতে চাইনা। ছাত্র রাজনীতি যেনো পেশিশক্তিনির্ভর, সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের সংস্কৃতির ধারক না হয়ে সামষ্টিক অধিকার সচেতনতা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মানবিকতার বিনির্মান ঘটাতে সহায়ক হয়ে উঠে সে জন্যে নীতিমালা প্রনয়ন হতে হবে।’

এ সময় ছাত্র ফেডারেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি, একাডেমিক পরিবেশ, শিক্ষক নিয়োগ, সিনেট, সিন্ডিকেট সভা ও যৌন নির্যাতন নিরোধ সেলসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।