ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ না সংস্কার?
- ইমরান হুসাইন, রাজশাহী
- প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৭ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫১ PM
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা থেকেই ছাত্র রাজনীতি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র নেতাদের অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সর্বোপরি ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নাকি সংস্কার সমাধান কি?
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ছাত্র রাজনীতি কেবল ছাত্রদের অধিকার রক্ষার একটি মাধ্যম নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির অংশ হিসেবেও দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র রাজনীতির চিত্র অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে এবং এই পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির যে চর্চা চলছে, তা পূর্বের ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস থেকে অনেকটাই বিচ্যূত। অতীতে ছাত্র রাজনীতি যেখানে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল, সেখানে এখন এটি অনেকটাই সহিংসতা, দুর্নীতি এবং দলীয় স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠন মূলত রাজনৈতিক দলের অংশ হিসেবে কাজ করছে এবং সেই দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র স্বার্থ এবং শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে অনেক ছাত্র সংগঠন সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে, যা শিক্ষার পরিবেশকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটছে।
ছাত্র রাজনীতির এই অবনতি এবং সহিংসতার পরিস্থিতি বিবেচনা করে, অনেকেই মনে করছেন যে ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। তাদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি না থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল কাজ—শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবে এবং শিক্ষার পরিবেশ আরও শান্তিপূর্ণ হবে। বিশেষ করে, দলীয় রাজনীতি যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে তখন তা ছাত্রদের শিক্ষাজীবনকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। দলীয় স্বার্থে ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসে ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে এই অপব্যবহার এবং সহিংসতার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে, ছাত্র রাজনীতিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার বিপরীতে একাধিক যুক্তিও রয়েছে। একদল বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্টজনের মতে, ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক ক্ষেত্র। এটি ছাত্রদের নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করে এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ তৈরি করে। যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করা যায়, ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সচেতন হতে সহায়তা করবে এবং তাদেরকে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করবে। নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে এর গঠনমূলক সংস্কার প্রয়োজন। রাজনীতিকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সংগঠন পরিচালনার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। যদি তারা নিজেদের স্বার্থে এবং শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য রাজনৈতিক চর্চা করে তবে তা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
ছাত্র রাজনীতির সংস্কার নিয়ে আলোচনা করলে বেশ কিছু বিষয় সামনে আসে।
প্রথমত, দলীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্ত করা অপরিহার্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির প্রভাব যতদিন থাকবে, ততদিন ছাত্র রাজনীতি তার মূল আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে সরে যাবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র সংগঠন তৈরি করতে উৎসাহিত করা উচিত, যাতে তারা দলের প্রভাবমুক্ত থেকে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার সহিংসতা বা দুর্নীতি বরদাশত করা উচিত নয়। যারা এই ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ছাত্র রাজনীতি পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ নীতিমালা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ দিতে হবে তবে সেই চর্চা যেন সহিংসতা বা সন্ত্রাসের আশ্রয় না নেয়; সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি করা সম্ভব হবে, যা ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা বন্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করা উচিত। যদি কোনো শিক্ষার্থী সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুষ্ঠু এবং নিরাপদ রাখা শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং সেই অধিকার রক্ষার জন্য প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে।
ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং শিক্ষার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা হতে পারে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধকরণ বা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এর ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে হবে। নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদী সমাধান পাওয়া যেতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই, নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে একটি কাঠামোবদ্ধ সংস্কার প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করবে এবং একইসঙ্গে সহিংসতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বা সংস্কার করা নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। তবে একথা নিশ্চিত যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতির অপব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষা অর্জন করতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে পারবে। ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তবে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু দলীয় স্বার্থ এবং সহিংসতার প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য ছাত্র রাজনীতির সংস্কার এখন সময়ের দাবি।