ঢাবি ভিসির কাছে শিবিরের স্মারকলিপি, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব
- ঢাবি প্রতিনিধি;
- প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৬ PM , আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৬ PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চলমান সংকট সমাধান এবং জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস বিনির্মাণের প্রস্তাবনা নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে ঢাবি শাখা শিবির।
স্মারকলিপিতে ক্যাম্পাস থেকে আইন করে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ, অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচনসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার (২১ অক্টোবর) দুপুরে উপাচার্য কার্যালয়ে এই স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
শাখা ছাত্রশিবির আশা করে, ক্যাম্পাসের সংকট ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা বিবেচনা করে প্রদত্ত প্রস্তাবনার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে টেকসই সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে বৈষম্যহীন, নিরাপদ ও ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস গঠনের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের প্রতিফলন ঘটবে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। একটি আদর্শ, নিরাপদ ও বৈষম্যবিহীন ক্যাম্পাস বিনির্মাণে ছাত্রশিবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সর্বাত্মক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
শিবিরের প্রস্তাবনায় যা যা রয়েছে...
ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন সংক্রান্ত
১. চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী ফ্যাসিবাদের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছিল, প্রত্যক্ষভাবে গণহত্যাকে সমর্থন ও পরোক্ষভাবে গণহত্যার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তাদেরকে চিহ্নিত করে অতিদ্রুত তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. বিগত ফ্যাসিবাদের শাসনামলে হলগুলোতে ছাত্র নির্যাতনের সাথে সম্পৃক্ত হল প্রভোস্ট, হাউস টিউটর এবং প্রক্টোরিয়াল বডির সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. পতিত ও পলাতক ফ্যাসিবাদের দোসর ও আইকনদের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে সকল স্থাপনা, সড়ক, সেন্টার, বৃত্তি-সম্মাননা, চেয়ার ও ফলকের নামকরণ করা হয়েছে, তা অবিলম্বে পরিবর্তন করে জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নামে নামকরণ করতে হবে। শহীদ আবু সাইদ, শহীদ মুগ্ধ, শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত, শহীদ ওয়াসিম, শহীদ আলী রায়হান, শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, শহীদ নাইমা, শহীদ সুমাইয়াসহ সকল শহীদেরা আমাদের জাতীয় বীর ও প্রেরণার বাতিঘর। জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে ভাস্বর রাখতে এবং ফ্যাসিবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস গঠনে শহীদদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের নামে স্থাপনা, সড়ক, ফলক, সেন্টার, বৃত্তি-সম্মাননা ইত্যাদি স্থাপন করতে হবে।
৪. চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বিশেষায়িত সেন্টার ও সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ইতিহাস, গুরুত্বপূর্ণ ছবি, সাহিত্য, ম্যাগাজিন, প্রকাশনা, পত্রিকা ও চিত্রকর্ম ইত্যাদি সংরক্ষিত থাকবে।
৫. জুলাই গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন করতে হবে এবং পর্যাপ্ত গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নির্মম ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ১৭ জুলাই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্তকরণ এবং যৌথবাহিনীর নৃশংস হামলার ভয়াবহতা স্মরণ করে ‘১৭ই জুলাই’-কে ‘ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
৭. সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের হাতে শহীদ আবু বকর হত্যার সুষ্ঠু (পুনঃ)বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার, সার্টিফিকেট বাতিল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৮. গত ১৬ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিদ্বেষসহ নানাবিধ নিপীড়ন ও বৈষম্যের ঘটনায় ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করতে হবে। এই আমলে আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার সকল শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৯. ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টি, বিগত ১৬ বছরের নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও জুলাই গণহত্যার দায়ে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।
১০. বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অভ্যন্তরে প্রকাশিত সকল দুর্নীতির তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে হবে।
আবাসন সংক্রান্ত
১. চলমান আবাসন সংকট নিরসন করে শতভাগ আবাসিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের জন্য ‘এক শিক্ষার্থী, এক সিট’ নীতি গ্রহণ করে, প্রয়োজনে দ্রুত হল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও যেসব শিক্ষার্থীকে হলে সিট বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে না তাদের জন্য সিট ভাড়া বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পরিমাণ মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ‘হল চালাবে প্রশাসন’ নীতিতে হল পরিচালনা, সিট বণ্টনসহ সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে হল প্রশাসন। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যাতে কোন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে প্রত্যেককেই প্রথম বর্ষ থেকে আবাসিক সিট বরাদ্দ দিতে হবে। সিট সংকট সমাধানের সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের নিকটবর্তী এলাকায় ছাত্রী হোস্টেল চালুর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং টেকসই সমাধান হিসেবে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে দু’টি নতুন হল নির্মাণ করতে হবে।
৪. ক্যাম্পাসে ঝুঁকিপূর্ণ সকল ভবন সংস্কার ও পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন ও দোকানগুলোতে খাবারের যথাযথ মান নিশ্চিত করতে হবে। খাবারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া কলা ভবন ক্যাফেটেরিয়া, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, হাকিম চত্বর, টিএসসি, ডাকসু, কলা ভবনের শ্যাডো সংলগ্ন দোকানগুলোর খাবারের মান বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬. পরিচয় শনাক্তকরণ সাপেক্ষে ছাত্রীদের এক হল থেকে অন্য হলে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। অনাবাসিক ছাত্রীদেরকে পরিচয় শনাক্তকরণ সাপেক্ষে হলে প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে।
৭. আবাসিক হলগুলোতে পড়ালেখার সুস্থ পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে রিডিং রুম ও লাইব্রেরির পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যেকটি আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে ডায়ালগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. আবাসিক হলগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা ও মেডিসিন কর্নার স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে কাছাকাছি অবস্থিত হলগুলোর জন্য একটি করে ফার্মেসি স্থাপন কিংবা প্রয়োজনীয় ওষুধের হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু করা যেতে পারে।
৯. কার্জন হল এবং কাজী মোতাহার হোসেন ভবন এরিয়ায় ক্যান্টিন স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
১০. হলগুলোতে সার্বিক কার্যক্রমে হাউজ টিউটরদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
১১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে। পূর্বাচলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত
১. বহিরাগত প্রবেশ ও অবাধ যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে প্রক্টরিয়াল বডির তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখগুলোয় স্থাপিত নিরাপত্তা চৌকিগুলোকে কার্যকর করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও সার্বক্ষণিক তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
২. পড়ালেখার পরিবেশ সংরক্ষণে একাডেমিক এরিয়ায় দীর্ঘসময় উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশের স্থান, যাত্রা বিরতি ও বাসস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল ও উচ্চস্বরে হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪. ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ( যেমন মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, পলাশী, টিএসসি, কার্জন হল, মল চত্বর ইত্যাদি) প্রক্টরিয়াল টিমের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ফুটপাতে থাকা সকল মাদকাসক্ত ও ভবঘুরে চক্র উৎখাত করতে হবে।
৬. ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
ডাকসু সংক্রান্ত
১. অবিলম্বে ডাকসু সক্রিয় করার মধ্য দিয়ে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির প্রবর্তন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দাবি-দাওয়া পেশের একটি সুন্দর সংযোগ স্থাপন করতে হবে।
২. ডাকসু জাদুঘরের সংস্কার এবং একে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সমৃদ্ধ সেন্টারে পরিণত করতে হবে।