এশিয়া-কে ব্যাংকার স্কুল ২০২৪ কর্মশালায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি রাবি শিক্ষার্থী

রাবি
মৌ নোশিন মোস্তফা (রাবি শিক্ষার্থী)  © সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তর একটি অপরিহার্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এশিয়া, তার বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর জন্য, এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে, এ অঞ্চলের দেশগুলো কি সত্যিই ডিজিটাল ফিন্যান্সে বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্থান দখল করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য নেইল নিউজ এবং কেবি কুকমিন ব্যাংকের উদ্যোগে বাব-ইল-ক্কুম সংস্থার আয়োজনে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত হলো এশিয়া-কে ব্যাংকার স্কুল ২০২৪ কর্মশালা।

সম্মেলনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের আর্থিক খাতের ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে আলোচনা করেন, যেখানে উঠে আসে চ্যালেঞ্জ, অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

সম্মেলনে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মৌ নোশিন মোস্তফা। তিনি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার কনকুক বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে অধ্যয়নরত। বাংলাদেশের হয়ে তিনি ডিজিটাল ফিন্যান্স খাতের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। বিশেষত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) খাতে বাংলাদেশের বাজারের আকার এবং এর দ্রুত অগ্রগতির তথ্য উপস্থাপনের পর অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি হয়। ২২১.৫ মিলিয়নের বেশি অ্যাকাউন্ট এবং প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ লেনদেনের পরিসংখ্যান এই খাতের শক্তি ও সম্ভাবনার দিকটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনের কারণ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

সম্মেলনে আলোচনা হয়, কীভাবে প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং প্রতারণার ঘটনা এই অগ্রগতিকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রতিনিধিদের মতে, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এই উপস্থাপনা বাংলাদেশের ডিজিটাল ফিন্যান্স খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি নতুন আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে।

ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং কাজাখস্তান থেকে আসা প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ দেশের ডিজিটাল ফিন্যান্স খাতের অগ্রগতি এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে মূল্যবান তথ্য উপস্থাপন করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, মোবাইল ফিন্যান্সিং এবং ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা তাদের বিশাল জনসংখ্যাকে আর্থিক সেবার আওতায় আনতে সহায়ক হয়েছে। কম্বোডিয়ার প্রতিনিধিরা ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। অন্যদিকে, কাজাখস্তানের প্রতিনিধিরা দেশটির খনিজ সম্পদ-নির্ভর অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক আর্থিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন। তবে, তারা স্বীকার করেন যে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব এবং দক্ষ মানবসম্পদের সংকট এই প্রচেষ্টাগুলোকে সীমিত করছে।

সম্মেলনে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি যেমন বিগ ডেটা, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং রোবো-অ্যাডভাইজরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, এসব প্রযুক্তি এশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে। তবে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা একটি সাধারণ সমস্যা, রোবো-অ্যাডভাইজর প্রযুক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি এবং ডিজিটাল শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

সম্মেলনে কেবি কুকমিন ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও বিশ্লেষণ করা হয়। ব্যাংকটি বিভিন্ন এশীয় দেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের সময় নানান ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কুকমিন ব্যাংক তার ডিজিটাল রূপান্তরের প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করতে পারে।

সম্মেলনে টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত, সামাজিক এবং প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা (ESG) নিশ্চিত করার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়। প্রতিনিধিরা জোর দেন, ডিজিটাল রূপান্তরের সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং টেকসই উন্নয়ন নীতিমালা অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ পর্যন্ত, প্রশ্নটি থেকে যায়—এশিয়া কি ডিজিটাল ফিন্যান্সে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে পারবে? সম্মেলনের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, সহযোগিতা, অভিজ্ঞতার বিনিময় এবং কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে এশিয়া এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে। বাংলাদেশের উদাহরণ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিগত উন্নতি এশিয়ার সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দেশগুলোকে নিজস্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পাশাপাশি সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।

এশিয়া-কে ব্যাংকার স্কুল ২০২৪ প্রমাণ করেছে যে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সহযোগিতার মাধ্যমে ডিজিটাল ফিন্যান্সে বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথ তৈরি করা সম্ভব। এশিয়া যদি সফল হয়, তবে এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই আর্থিক ভবিষ্যতের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।