কোটি কোটি টাকার মালিক মশিবুর, সাহাবুদ্দিনের লাগামহীন দুর্নীতি
- সারওয়ার মাহমুদ,চবি
- প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ PM , আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ PM
মুশিবুর রহমান,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অফিসের সহকারী রেজিস্ট্রার। বেতন স্কেলে মাসিক বেতন ২৯ হাজার টাকা মাত্র কিন্তু অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন জায়গায় তার নিজের এবং স্ত্রীর নামে চারটি ফ্ল্যাট,বেশ কয়েকটি প্লট এবং ব্যাংকে রয়েছে কোটি টাকার উপরে। ক্যাম্পাসের নীপবন স্কুল সংলগ্ন 'প্রগতি একুশ' নামে নির্মিত দশতলা এক বিল্ডিংয়েই আছে চারটি ফ্ল্যাট। অভিযোগ রয়েছে আরো একটি ফ্ল্যাট জোর করে দখল করার। শুধু এই বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাট গুলোর বাজারমূল্য কম করে হলেও প্রায় দুই কোটি টাকা ,হাটহাজারীতে নিজ এলাকায় রয়েছে আলিশান বাড়ি ও বেশ কয়েকটি প্লট।
সাবেক তিন উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ, ইফতেখার চৌধুরী এবং শিরীন আখতারের আমলে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সময় অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী বলেন একজন সহকারী রেজিস্ট্রার হয়ে অবৈধ উপায়ে গত ১৬ বছর দুর্নীতি করতে করতে কোটিপতি বনে গেছেন মশিবুর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুঁইফোড় সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যে ভাগ নিয়ে নিজের এবং স্ত্রীর নামে বাগিয়ে নিয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দলীয় জোর দেখিয়ে দখল করে লিজ নিয়ে ভাড়া দেয় মশিবুর।
বিগত দিনগুলোতে কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রমোশনের জন্য আলাদা লিস্ট দেওয়া নেওয়া করতো এই মশিবুর। বিএনপি জামায়াত এবং ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের যারা ছিল তাদের কে হয়রানি ও চাঁদা দাবি করতো। কাদের কে প্রমোশন দেয়া হবে কি হবে না এমন করে লিস্ট জমা দিতো বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে। রাজনৈতিক জোরে স্ত্রীর নামে লিজ নিয়েছেন ক্যাম্পাসের ২নং গেইটের বেশ কয়েকটি দোকান।
তার লিজ নেওয়া জায়গায় ব্যবসা করা এক দোকানদার জানায়,মশিবুর আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক দলের সুবিধা নিয়ে এই জায়গা গুলো লিজ নেয় তার স্ত্রীর নামে। পরে এক এক করে পুরো মার্কেট টাই তার কব্জায় নিয়ে নেয়। ছাত্রলীগের ছেলেদের কাজে লাগিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তার নামে ৩ টি ফ্লাট আছে এবং ঐ বিল্ডিংয়ের ১২ জন শেয়ারের মধ্যে মশিবুর একজন বলে স্বীকার করেন। তবে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন আমি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ঠিক কিন্তু কোনো অনিয়মের সাথে জড়িত না। বিভিন্ন সময়ে লোন, স্ত্রীর সম্পদ এবং পৈতৃক সম্পত্তি দিয়েই এগুলো করেছি। শিরীন আখতার প্রশাসনের সময় নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে উল্টা তাকে বদলি করা হয় বলে অভিযোগ করেন। তবে পরবর্তীতে জানা যায় দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় তাকে সে সময় বদলি করা হয়।
মশিবুর যদি চুনোপুঁটি হয় তাহলে দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের রাঘববোয়াল হলো আরেক সহকারী রেজিস্ট্রার মোঃ সাহাবুদ্দিন।গত ১৬ বছরে অবৈধ নিয়োগের রাণী খ্যাত সাবেক উপাচার্য শিরীন আখতারের আমলে সাহাবুদ্দিন তার পরিবারের ডজন খানেক আত্মীয় স্বজন কে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে ঢুকিয়েছে।হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগে বদলি করা হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে,অতীতে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করানোর চেষ্টা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সাহাবুদ্দিনের আপন ছোট ভাই মঈন উদ্দিন হিসাব নিয়ামক দপ্তরের নিম্নমান সহকারী এই দপ্তরের উচ্চমান সহকারী তার আরেক চাচাতো ভাই ইয়াসিন আরাফাত,শাহাবুদ্দিনের ভাবী তাসলিমা আক্তার চাকরি করছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উচ্চমান সহকারী হিসেবে। এছাড়াও তার আত্নীয় স্বজন চাকরি করছে চবি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগ সহ বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন সূত্র জানায় সাবেক উপাচার্যের দপ্তরে থাকার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে ভিসির রেফারেন্স দিয়ে ৩য় শ্রেনী -৪র্থ শ্রেনীর কোন কোন পদ খালি আছে তার তালিকা নিয়ে যেতেন সাহাবুদ্দিন।
অভিযোগ রয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা গাজী হাফিজুল ইসলাম লিকুর রেফারেন্স দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা ব্যক্তিদের স্বাক্ষর জাল করে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করার।এই ধরনের অভিযোগে ইতিপূর্বে তার চাচাতো ভাই ইয়াসিন আরাফাত বেশ কয়েকদিন জিবি হেফাজতেও ছিলেন। ভিসির দপ্তরে দায়িত্ব পালনকালে ভুয়া বিল বানিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভিসির বাংলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে ৩ লাখ টাকার বিল ১৬ লাখ টাকা করা, করোনা কালীন সময়ে উপাচার্যের কুয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয় এর বিলেও ব্যাপক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের নিয়োগ বাণিজ্যের ফোন আলাপ ফাঁসের যে ঘটনা ঘটে ঐ সময় ফাইল গোপন করে ফেলার অভিযোগে এই সাহাবুদ্দিনের দায় পেয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশে ভিসির দপ্তর থেকে বদলি করা হয়।
সাহাবুদ্দিনের সাথে কর্মরত অনেকেই জানান - গত ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ধরনের দুর্নীতি হয়েছে তার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল সাহাবুদ্দিন চক্র। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত তাদের আয়ের উৎস, অঢেল সম্পদের হিসাব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে করা দুর্নীতির বিচারের মুখোমুখি করা।
এইসব অভিযোগ নিয়ে সাহাবুদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি গাজী হাফিজুল ইসলাম লিকুর সাথে সখ্যতার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন- জ্বি আমি উনাকে চিনতাম ম্যাডাম (সাবেক উপাচার্য শিরীন আখতার)যেতেন সে হিসেবে পরিচয়। তবে উনার রেফারেন্সে কাউকে চাকরি দিয়েছি এই বিষয়টি সত্য নয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসা দুর্নীতি অনিয়মের ব্যাপারে তিনি বলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার সকল সম্পদের হিসাব আছে চাইলে তারা দেখতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাহাবুদ্দিন,মশিবুর সহ একাধিক কর্মকর্তা সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিল যারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। সাহাবুদ্দিন , মশিবুর গ্যাংয়ের সাবেক উপাচার্য শিরীন আখতারের ভাতিজার সাথেও অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। চবিতে বিগত দিনগুলোতে করা অনিয়ম দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তদন্ত করতে গঠন করা হয়েছে কমিটি। কমিটির সভাপতি জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড আতিয়ার রহমানকে মোঃ সাহাবুদ্দিন,মশিবুর রহমান সহ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে অবহিত করা হয়েছে।