আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড:
বেরোবির সিদ্ধান্তের ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও বিচারের আওতায় আসেনি অপরাধীরা
- আহসান হাবীব, বেরোবি প্রতিনিধি:
- প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩০ PM , আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩০ PM

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানায়ক রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের শাস্তির সিদ্ধান্তের ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়নি কোন আইনানুগ ব্যবস্থা। আবাসিক হলের সন্ত্রাসীদের রুমে অস্ত্র পাওয়া গেলেও তাদের নামে আজও হয়নি কোন মামলা । এতে চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, ২৮ অক্টোবর ২০২৪, দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮ তম সিন্ডিকেট সভায় শেষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দুই শিক্ষক এবং ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেই ক্ষান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সিন্ডিকেট সভার ৪মাস পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়নি কোন আইনানুগ ব্যবস্থা।
পরবর্তীতে ২০ জানুয়ারি ২০২৫, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯ তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যাকান্ডে জড়িত ৭১ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সেমিস্টার অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা বোর্ড ২৩ জনকে এক সেমিস্টার, ৩৩ জন দুই সেমিস্টার ও ১৫ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগতব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের এতো কম শাস্তি দেওয়ার কথা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন- কর্মসূচি করলেও তা আমলে নেননি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত নেই কোন বাস্তব প্রতিফলন। অভিযুক্ত ১৫ জনের তালিকায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি পমেল বড়ুয়া, সেক্রেটারি শামীম মাহাফুজ, ধনঞ্জয় কুমার টগর, গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), বাবুল, বিধান, তানভীর, আদুল্লাহ আল নোমান খান, রিফাত, ফারহাদ হোসেন এলিট, মোমিনুল,আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান, মামুন।
২য় সেমিস্টার বহিষ্কার হওয়া ৩৩ জনের তালিকায় রয়েছেন, সেজান আহমেদ (ওরফে আরিফ) মোঃ আরাফাত রহমান আবির, আবু সালেহ নাহিদ, ইমরান চৌধুরী আকাশ, কফি আনান মান্নান, মাসুদুল হাসান, উজ্জ্বল মিয়া, হাবিবুর রহমান, সাখাওয়াত হোসেন, শোয়াইবুল (সাল্লু), আব্দুল্লাহ আল রায়হান, বায়েজিদ মোস্তাফী, রাসেল, সিয়াম আল নাহিদ, অমিত, আখতার হোসেন, তানজিল, মুন্না হাসান লিওন, জিহান আলী, মোঃ সাব্বির হোসেন (রিয়ান), গালিব হাসান, মাহমুদুর রহমান হৃদয়, মোঃ মোশারফ হোসেন, পিপাস আলী, মোজাম্মেল হক, মৃত্যুঞ্জয় রায়, মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, মানিক চন্দ্র সেন, রবীন্দ্র রায়, সিয়াম আরাফাত, মোঃ সাব্বির আহমেদ, মোঃ মুসান্না-বিন-আহমেদ, শাহীন ইসলাম।
প্রথম সেমিস্টার বহিষ্কার হওয়া ২৩ জনের তালিকায় আছেন, মোঃ হাসানুজ্জামান সৌমিক,সুদিপ্ত সরকার বাঁধন,জুবায়ের মাহমুদ,কোমল দেবনাথ,মোঃ রিজন মন্ডল,মোঃ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ,ফিলিপ রায়,জিহাদ উল্লাহ,এস এম লাবু ইসলাম,জয়ন্ত চন্দ্র রায়,সবুজ কুমার,সবুজ হাসান মিরাজ,জামাল মিয়া,তৌফিক কিবরিয়া,মেজবাহুল সরকার জয়,দেবাশীষ কুমার রায়,আতেফ আসহাব দিল মণ্ডল,নাফিউল ইসলাম,তপন চৌধুরী,সাজেদুর রহমান,আমিরুল ইসলাম শুভ, শফিউল আযম ওরফে (সম্রাট)।
এছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দিনের বিভিন্ন মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিতি প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিতি নিয়ে এখনো ধোয়াশা রয়ে গেছে। এমনকি তদন্ত কমিটিও তাদেরকে তদন্তের আওতায় আনেননি।
তাদের মধ্যে সাবেক ভিসির পিএ নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ,পরিবহন পুলের উপ পরিচালক তাপস কুমার গোস্বামী, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন সর্দার, পেনশন শাখার উপ-পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর নুরুজ্জামান, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে কর্মচারী বিপ্লব,বহিষ্কৃত সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ, ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুল ইসলাম, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মচারী ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মাহবুবার রহমান, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়া, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার উপ-রেজিস্ট্রার হাফিজ আল আসাদ রুবেল, মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আহসান হাবীব তুষার, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সেশন অফিসার এ কে এম রাহিমুল ইসলাম দিপু, প্রক্টর অফিসের কর্মচারী মো. আপেল এবং সংস্থাপন শাখা-১ এর কর্মচারী সবুজ মিয়াকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ছাত্রলীগ ও পুলিশের পাশে দেখা গেছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়াকে। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে একটি বড় ইট হাতে তাকে দেখতে পাওয়া যায়।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাদের এক বা দুই সেমিস্টার বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এদের মধ্যে অনেকে আবু সাঈদ হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তারা আরও জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের শাস্তি স্থায়ী বহিষ্কার। আর হত্যার শাস্তি হয় ড্রপ সেমিস্টার।
এ বিষয়ে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বলেন, আমরা চাচ্ছিলাম যারা আহত তারাই শুধু সাক্ষ্য দিবেন। কিন্তু তারা অধিকাংশই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ না করায় আমরা এখন নিজেরাই সাক্ষ্য দিবো।
আবু সাঈদের সহযোদ্ধা এস এম আশিকুর রহমান বলেন,আমার অপরাধীদের নামে মামলা করার জন্য সাক্ষীর লিস্ট তৈরি করছি। দ্রুতই সাক্ষীর তালিকাটা প্রশাসনে জমা দেওয়া হবে ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বলেন, এখন সবাই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।প্রশাসন ব্যস্ত তাদের নিজের কাজে আর সমন্বয়করা ব্যস্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। ভুলে গেছে আবু সাঈদকে। দুঃখজনক বিষয়, বার বার কমিটি গঠন এবং সংবাদ সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ আবু সাঈদ হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের ব্যবস্থা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো ফেরদৌস রহমান বলেন, ২ জন শিক্ষক এবং সাত জন কর্মকর্তা - কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমার ৩ বার নোটিশ দিবো । এরপরেও কোন উত্তর না পেলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে। আর তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য উপচার্য স্যার হয়তো দ্রুতই আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, আমরা কাজ করছি। আবু সাঈদ ও তার সহপাঠীদের ওপর হামলাকারীদের খুব শীঘ্রই বিচারের আওতায় আনা হবে। সন্ত্রাসীরা কেউই ছাড় পাবে না। শীঘ্রই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবো। কোন অপরাধীকে বিন্দু মাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে পিবিআই এর এসপি এবিএম জাকির হোসেন হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরজমিনে তদন্ত করে গেছেন। আশা করি মার্চের মধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হবে।