দুখু মিয়া: সৈনিকের জীবন থেকে সাম্যবাদী বিদ্রোহী কবির অবিনশ্বর যাত্রা
- মারসিফুল আলম রিমন
- প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ০২:০৮ PM , আপডেট: ২৫ মে ২০২৫, ০২:০৮ PM

সময়টা ১৯২২। ভারতবর্ষে চলছে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের শেষ পর্যায়। পথে-ঘাটে প্রতিরোধ, জনতা উত্তাল, বাতাসে যেন স্বাধীনতার গন্ধ। এমন এক উত্তাল মুহূর্তে আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলে ওঠেন ২৩ বছরের এক যুবক—নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
তাঁর হাতে অস্ত্র নয়, কলম। তাঁর গলায় সুর নয়, বজ্রকণ্ঠ। আর তাঁর চোখে ছিল এক নতুন ভোরের স্বপ্ন—স্বাধীন, সাম্যবাদী, মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন একটি পৃথিবী। অন্যায়, অনাচার আর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যেন এক গণজাগরণী মন্ত্র। নজরুল তখন সম্পাদনা করছেন 'ধূমকেতু'—এক সাপ্তাহিক পত্রিকা, যার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: “জাতীয়তাবাদী চেতনায় আগুন জ্বালানো, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলা, আর ব্রিটিশদের বুকে সাহসের বিদ্রোহী ছুরি চালানো!”
তিনি নিজেই বলেছিলেন, “এই পত্রিকা আমার ধূমকেতু—বুকে আগুন জ্বালিয়ে এসেছে।”
এই আগুনই একদিন তাঁকে পরিণত করে "বিদ্রোহী কবি"তে
বৃটিশ সরকার যখন জনগণের কণ্ঠরোধ করতে বারবার নির্যাতন, সেন্সরশিপ ও দমননীতি প্রয়োগ করছিল নজরুল এ পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর সাহিত্যকে করেছিলেন এক প্রতিরোধের অস্ত্র। তার বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমন’ এ লেখেন-
“বাজিবে আবার বাঁশি আনন্দধ্বনি,
জাগিবে ভারত, জাগিবে জননী!
আনন্দময়ীর আগমন হোক,
দুঃখময়ীর বিসর্জন!”
এ কবিতার কারনে নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা (Sedition) মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। কিন্ত সুপ্ত এই বিদ্রোহী মনকে কি চাইলেই থামিয়ে রাখা সম্ভব? তাঁর কারাবরণ শুধুমাত্র শারীরিক অবরোধ ছিল না, বরং তা ছিল এক চেতনাগত যুদ্ধ—যেখানে তিনি সাহিত্যের ভাষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর জেলজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর রচনায় আরও বেশি প্রেরণা ও সংগ্রামী স্পৃহা এনে দেয়।
জেলেই তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী ও অমর সাহিত্য। তাঁর জেলজীবন ছিল এক রকম ‘প্রতিরোধের উপাসনালয়’, যেখানে বন্দিত্বের শিকলও তাঁকে থামাতে পারেনি। সৃষ্টি করেছেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ – সাহসিকতায় ভরা, এক মহান রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র কিংবা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ – অমর প্রতিবাদী কবিতা, যার প্রতিটি পঙক্তিতে বিদ্রোহের আগুন। তিনি যখন ঘোষণা দেন,
“ভেঙে ফেল কর রে লোপাট!
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী গায়” তখন তা যেন বৃটিশদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে একট শিকলভাঙ্গা করাঘাত হয়ে ওঠে। এটি তাঁর বিদ্রোহী চেতনা, স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষা ও সাহসী আত্মঘোষণার প্রতীক।
তবে নজরুলের মানবিকতা, ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী-পুরুষের সমতার বন্দনার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। ব্যাক্তিগত জীবনের দুর্দশা, জীবনবোধ, দর্শন তাকে প্রভাবিত করেছে শোষিত শ্রেণীর প্রতি। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে যখন নজরুল বর্ধমান জেলায় পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন, বাবা কাজী ফকির আহমেদ তখন পরিবারের অভাব-অনটন আর দুর্দশা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাত্র ৯ বছরেই বাবার মৃত্যুর পর নজরুলের সেই আমাবস্যার নিশি যেন আরও ঘনীভূত। ১০ বছর বয়সেই জীবিকার সন্ধানে নজরুলকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে মসজিদ থেকে মক্তবে কিংবা লেটো গানের দল থেকে রুটির দোকনে। জীবিকা সংগ্রহের এই নির্মম বাস্তবতাই যেন তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া'র প্রতিরুপ।
লেটো দলের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়। তাঁর সাহিত্যেও এই সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, বেদনা, প্রেম ও প্রতিবাদের প্রতিফলন পাওয়া যায়। এই লেটোদলে থেকেই তার জীবনের প্রেমময় জীবনের সূচনা ঘটে। লিখে ফেলেন জগৎ বিখ্যাত সেই পঙ্কক্তি– "তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?" লেটো দলে থাকাকালীনই তার জীবনে ‘নাহিফ’ নামক এক কিশোরীর প্রতি জীবনের প্রথম প্রেমের সূচনা। নাহিফের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অপূর্ণ, সমাজ ও বাস্তবতার কাছে হার মেনেছে। নজরুলের প্রেমের কবিতাগুলোয় বারবার অপূর্ণতা, বিরহ, আকুলতা ও ব্যথা ফিরে ফিরে আসে। নজরুলের প্রেমের কবিতাগুলোতে আমরা যে বিরহ, আকুলতা ও আত্মত্যাগ দেখি—তা কেবল কল্পনার নয়; বরং জীবনের ব্যর্থ প্রেম, বিচ্ছেদ ও স্মৃতিরই শিল্পিত রূপ। নাহিফের স্মরণে লেখা “আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দিও না ভুলিতে...” যেন এক প্রেমময় বিরহেরই প্রতিরুপ।
নজরুলের বিপ্লবী রূপের ভিত গড়ে উঠেছিল এক সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার উপর, যেখানে সাহস, শৃঙ্খলা ও বেদনার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল তাঁর অভ্যন্তরীণ এক অন্য নজরুল।
১৯১৭ সাল, নজরুল তখন যুবক। মফস্বলের এক দরিদ্র কিশোর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। প্রথমে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্টে’ এবং পরে ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক প্রান্তিক যোদ্ধা, মোতায়েন হয়েছিলেন করাচি ক্যান্টনমেন্টে।
এই সময়টি নজরুলের জীবনের অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভরা। একদিকে তাঁর হাতে ছিল অস্ত্র, অন্যদিকে বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলছিল কাব্যিক আগুন। রাতে যখন শিবির নিস্তব্ধ, তখন যুদ্ধক্ষেত্রের বালুরাশি ও গুলির আওয়াজ পেরিয়ে নজরুল লিখতেন কবিতা, অনুবাদ করতেন আরবি-ফারসি গান, এবং গেয়ে উঠতেন: "আমি চির-দুরন্ত, দুঃসাহসিক
আমি এক ধূমকেতু! আমি বিদ্রোহী!”
এই সৈনিক জীবন তাঁকে দিয়েছে শৃঙ্খলা, দ্রোহের উপলব্ধি, আর যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা। যাঁরা মনে করেন কবি শুধু কল্পনার মানুষ, তাঁরা হয়তো জানেন না যে, নজরুল যুদ্ধকে দেখেছেন চোখের সামনে, সহযোদ্ধাদের মৃত্যু দেখেছেন, বিদ্রোহে রক্তের গন্ধ পেয়েছেন।
তার যুদ্ধের বিভীষিকার মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতার সূর্যোদয়। সৈনিক থেকে সাম্য ও মানবতাবাদী কবি হয়ে ওঠার এই যাত্রা নজরুলকে করেছে অনন্য, অসাধারণ ও অবিনাশী। নজরুল বুঝেছিলেন, যুদ্ধ শুধু মাটি দখলের খেলা নয়—এ এক মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করার নির্মম আয়োজন।
তিনি উপলব্ধি করেন, অস্ত্র নয়, মানবতা-ই পারে পৃথিবীকে সত্যিকারের রক্ষা করতে।এই উপলব্ধি থেকেই তিনি লিখলেন: “গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।”
সৈনিক নজরুল কলম হাতে তুলে নেন বিদ্রোহের ভাষায়, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য যুদ্ধ নয়, মুক্তি—দারিদ্র্য থেকে, ধর্মান্ধতা থেকে, উপনিবেশ থেকে। তাই তিনি হন মানবতার কবি—যিনি মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও গুরদ্বার—সবখানেই দেখতে পান এক অভিন্ন স্রষ্টার মুখ। তিনি লিখেন:“মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।”
কেবলই ধর্মীয় ভেদাভেদকে দূরে রাখার অভিপ্রায়ই নয়, নজরুল তার লেখেনিতে তুলে এনেছেন তৎকালীন ভারতবর্ষে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে তিনি দিয়েছেন জাগরণী বার্তা, “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নজরুলের সময় ছিল এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে নারী ছিল গৃহের অন্তঃপুরে সীমাবদ্ধ, শিক্ষা ও মতপ্রকাশের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। সে সময় নারীর মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারে। এই প্রেক্ষাপটে নজরুল নারীকে শুধু প্রেমিকা বা মা নয়, মানব সভ্যতার সমান অংশীদার হিসেবে দেখেছেন।
“কে বলেছে নারী অবলা?
কারা বলেছে সে অধমা?”
এই প্রশ্ন শুধু কবিতার সৌন্দর্য নয়, এটি এক দৃঢ় প্রতিবাদ—যা নারীর প্রতি অন্যায় ও অবজ্ঞার বিরুদ্ধে ঘোষণা। তিনি নারীকে শক্তির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করেছেন—যিনি কখনো মাতৃরূপিণী, কখনো প্রেমিকা, কখনো বিদ্রোহিনী।
নজরুলের বিদ্রোহ কেবল রাজনীতি নয়—তা আত্মার, চিন্তার, ভালোবাসার বিদ্রোহ। তরুণ প্রজন্ম যদি তাঁর চেতনায় জাগে, তবে তারা শুধু নিজেদেরই নয়—সমগ্র সমাজ, জাতি, এমনকি বিশ্বের চেহারাও বদলে দিতে পারবে।
তরুণ, আজ তোমার হাতেই নজরুলের সেই কলম, সেই গান, সেই দীপ্তি। এখন তোমার পালা—বিদ্রোহ করো অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ভালোবাসো মানুষকে মন দিয়ে, আর গড়ে তোলো একটি সাম্যের পৃথিবী।