কীটনাশক ছাড়া সবজি চাষে ভাগ্য ফিরছে কৃষকদের

সবজি
কীটনাশক ছাড়া সবজি  © ফাইল ছবি

দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া ছিলেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সেনেরচরের রফিকুল ইসলাম। গত বছরের ডিসেম্বরে গ্রামে ফিরে শুরু করেন কীটনাশক ছাড়া নিরাপদ সবজি চাষ।

ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, টম্যাটো, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। তার মতো শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরায় রয়েছেন কয়েক শ কৃষক। ভাগ্য ফিরেছে তাদেরও।

কীটনাশক ছাড়া নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে শতভাগ জৈব পদ্ধতিতে। ব্যবহার করা হচ্ছে না কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। তাই এসব সবজির দামও যেমন বেশি পাচ্ছেন কৃষক, বাজারে চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। অধিক লাভের আশায় এ মৌসুমে পরিচর্যা ও বেচাবিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার সবজি চাষিরা। সারা বছর সবজি চাষের মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে পরিণত করেছেন তিন ফসলি জমিতে, পাচ্ছেন সফলতা।

বৃহস্পতিবার জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় সরেজমিনে দেখা যায়, লাউখোলায় বিঘার পর বিঘা জমিতে নানা ধরনের সবজি চাষ করেছেন কৃষক। ফারুক কাজী নামের এক কৃষক জানান, তিনি ২৪ শতক জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করেছেন।

এতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন। যেখানে ৬০ হাজার টাকাই তার লাভ হবে। নিরাপদ এই সবজি একেকটি দুই কেজি থেকে আড়াই কেজি হয়। কেজি ৪০ টাকা করে বিক্রি হবে। লাভ এত বেশি হওয়ার কারণ হিসাবে তিনি জানান, রাসায়নিক সার কিনতে হয় না, জৈবসার ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। পোকামাকড় মারার জন্য ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ আঠাল ফাঁদ, ভার্মিকম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট প্রভৃতি জৈবিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যে কারণে অনেক টাকা বেঁচে যায়, লাভ বেশি হয়। একই গ্রামে বিলকিস বেগম, রাহিরা বেগম, হালিমা বেগম, ফরিদা বেগম, মাসুদা বেগম, পিয়ারা বেগমসহ উপজেলার অনেক চাষি নানা ধরনের নিরাপদ সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ কম ও দাম বেশি পাওয়ায় এ ধরনের সবজি চাষ চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তাদের দেখাদেখি উৎসাহিত হচ্ছেন অন্য চাষিরাও। এখানকার উৎপাদিত নিরাপদ সবজিগুলো স্থানীয় ও দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ভবিষ্যতে বিদেশেও রপ্তানির আশা করছেন তারা।

সেনেরচরের রফিকুল ইসলাম জানান, টম্যাটো ২০ শতাংশ জাগায় চাষ করেছি। লালশাক, পালনশাক, লাউও চাষ করেছি। এছাড়াও পেঁয়াজ, রসুনও ৩ বিঘা জমিতে লাগিয়েছি। এসবে কোনো রাসায়নিক সার দিইনি। গোবরের জৈবসার ব্যবহার করি।

চাহিদা বেশি, বিক্রি ভালো হয়। বাজারে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। শুধু টম্যাটো দিয়েই ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো লাভ হবে। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে অনেকে সরাসরি ঢাকা নিয়ে যায় সবজি। সবজির পর, পাট, আবার ধানও-এক বছরে এ তিন ধরনের ফসল পাই। রফিকুল ইসলামের মতো কালাই মৃধা, তৈয়ব আলী চৌকিদার, ইসমাইল মৃধা অনেকেই আছেন যারা কীটনাশক ছাড়া সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নমিতা হালদার বলেন, কেমিক্যাল সার বাদ দিলে সব সবজিই নিরাপদ। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে সবজি উৎপাদন ভালো হয় না। তখন বিকল্প হিসাবে আমরা কিছু বেছে নিই। সেটা ভার্মিকম্পোস্ট, গোবর সার, ট্রাইকো কম্পোস্ট-এসব দেশীয় প্রযুক্তিতে উৎপন্ন করা হয়েছে। এসব ট্রাপ ব্যবহার করে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি।

কোনো কোনো জায়গায় সামন্য পরিমাণ হলেও কেমিক্যাল সার দিতে হয়। এর কারণ, আমাদের মাটিতে ফসল দ্বিগুণ-তিনগুণ উৎপাদন করতে গিয়ে অর্গানিক ম্যাটার যেটা জৈব পদার্থ, তা মাটিতে পয়েন্ট ৫ শতাংশও এখন নেই। ফলে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণের জন্য কিছু কিছু কেমিক্যাল সারের পাশাপাশি কিছু জৈবসারও দিতে হয়। ১০ শতাংশ কেমিক্যাল সার দিই, ৮০ শতাংশই জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করছি। যে কারণে আমরা নিরাপদ বলছি, যা শরীরে গিয়ে বিশাক্ত করবে না। এটাই হচ্ছে নিরাপদ সবজির টেকনোলজি।

নড়িয়া উন্নয়ন সমিতির (নুসা) উপপরিচালক মো. কবির হোসেন জানান, মাঠ ফসলে যেহেতু রাসায়নিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ২৫ থেকে ৩৫ দিন পর কর্তন করা হয়, সেহেতু তা সহনশীল নিরাপদ অবস্থার মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু সবজিজাতীয় ফসলের জন্য কোনো অপেক্ষমাণ সময় না পাওয়ায় তা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

তাই সরকারের এসডিজি ২০৪১ অর্জনের লক্ষ্যে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আর্থিক সহায়তায় নুসা নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে সদস্যদের মধ্যে আর্থিক ঋণ, অনুদান ও কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করতে এগিয়ে আসছে।

তিনি বলেন, উৎপাদিত সবজি যাতে সচেতন ভোক্তার কাছে পৌঁছায়, এজন্য নড়িয়া উপজেলার ডগ্রীবাজারে নিরাপদ সবজি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেল সেন্টারে উৎপাদনকারীরা নিরাপদ সবজি পাইকারি বিক্রি করেন এবং সেল সেন্টারের মালিক তা ক্রেতার কাছে খুচরা হিসাবে বিক্রি করেন। নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারীরা অধিক লাভবান হচ্ছেন। ফলে কৃষক অর্থিক লাভবানের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও পাচ্ছেন।

নড়িয়া উন্নয়ন সমিতির (নুসা) কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, নিরাপদ সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। ফলে বাস্তুসংস্থান নিরাপদ থাকে। স্প্রেকারী দূষণ হয় না, ফলে শ্বাষকষ্টজনিত রোগ হয় না।

দূষণজনিত সমস্যায় চোখ ও চামড়া আক্রান্ত হয় না, যার জন্য মেডিকেল খরচও সাশ্রয়ী হয়। নিরাপদ সবজি গ্রহণ করার ফলে অ্যালার্জি সমস্যায় ভুগতে হয় না। উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, ডায়াবেটিসজনিত নানা ধরনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ম্যানকোজেব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করার ফলে ১০ শতাংশ রোগী বন্ধ্যত্বজনিত সমস্যায় ভোগে। যেহেতু নিরাপদ সবজিতে এটি ব্যবহার করা হয় না, তাই এই রোগের ঝুঁকি থাকে না।

পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ডেপুটি ম্যানেজার (প্রোগ্রাম) মো. আব্দুল হাকিম বলেন, নিরাপদ সবজির উৎপাদনের যে টেকনোলজিগুলো সেগুলোর উপকরণ আমরা সদস্যদের অনুদানের মাধ্যমে দিয়ে থাকি। এ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিই। নিরাপদ সবজি উপকরণের কীটনাশকের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করি। এজন্য পোকামাকড় দমনের জন্য ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ আঠাল ফাঁদ, ট্রাইকো কম্পোস্ট প্রভৃতি জৈবিক পদ্ধতি ব্যবহার করি। জৈবসারের ব্যবহারকে উৎসাহিত করি। উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে যেসব পরিচর্চা করা দরকার, তা আমরা করি।

বৃহস্পতিবার পিকেএসএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নমিতা হালদার শরীয়তপুরের নড়িয়া উন্নয়ন সমিতি (নুসা) ও এসডিএস-এর মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন পিকেএসএফ-এর সাধারণ পর্যদের সদস্য আকতারী মমতাজ, মাহমুদা বেগম ও উম্মুল হাছনা, মহাব্যবস্থাপক (কার্যক্রম) ড. শরীফ আহম্মদ চৌধুরী, উপব্যবস্থাপক মাসুম আল জাকী প্রমুখ।

পিকেএসএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নমিতা হালদার আরও বলেন, আমরা টেকনোলজি দিই আমাদের পার্টনারের অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে যারা উপকারভোগী কৃষক আছেন, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য আমরা সহায়তা নিচ্ছি স্থানীয় প্রশাসনের। এখানে একটা ত্রিপক্ষীয় কাজ হয়।

এটা পিকেএসএফ আয়োজন করে, এসডিএস সঙ্গে থাকে, মাঠে কৃষকরা থাকেন এবং সরকারের রেগুলার যে বিভাগগুলো, সেগুলোও আমাদের সঙ্গে থাকে। প্রশিক্ষণ আমাদের একটা অবদান। আমারা যে প্রযুক্তি দেব, এর জন্য কোনোটা লোন দিই, কোনোটা অনুদান। প্রজেক্টের মাধ্যমে যেসব অনুদান পাই, তারই একটা অংশ আবার কৃষকদের দিই। এভাবেই মাঠে কাজ করি।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ