আতঙ্কের রাজ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প
- কনক বড়ুয়া, উখিয়া
- প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:৫৯ PM , আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:১৭ PM

মাদক ব্যবসা এবং ক্যাম্পে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সশস্ত্র মহড়া চালাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। জিরো পয়েন্ট ক্যাম্পে মজুত করছে গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারসহ ভারী অস্ত্র। এমন খবর শোনা যাচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মুখে। সব মিলিয়ে ভয়ের রাজ্যে পরিনত হয়েছে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো। সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরের কয়েকজন মাঝিকে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এখন আরও বেপরোয়া। তারা জড়াচ্ছে একের পর এক হত্যায়। নতুন করে মিলছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গ্রেনেড। তুমব্রুর শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের গোপন আস্তানা। হত্যার ঘটনার পরই শূন্যরেখার ক্যাম্পে তারা পালিয়ে যায়। এ কারণে অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে বর্তমানে ক্যাম্পজুড়ে রাজত্ব করছে আরসা ও নবী হোসেন গ্রুপ। আর ক্যাম্পে রয়েছে তাদের উপগ্রুপ। মূলত ইয়াবা ব্যবসাকে ঘিরেই খুনের মহড়া চলে তাদের মাঝে। তাদের উগ্রতা ক্যাম্প ছাড়িয়ে প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের মাঝে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এর মধ্যে গত সাত মাসে ৩২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশিভাগ ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক।
সর্বশেষ কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে দেশি ও বিদেশি অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ দুই শীর্ষ জঙ্গি আটক করেছে র্যাব-১৫ এর সদস্যরা। অস্ত্র ছাড়াও ঐ অভিযানে তিনটি ম্যাগাজিন, ১১২ রাউন্ড গুলি ও নগদ আড়াই লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার করা হয়। আটক দুজনের মধ্যে একজন হলেন কথিত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর এবং অন্যজন হলেন তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার।
গত দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক ঘটছে আতঙ্কের ঘটনা। এ যেন সন্ত্রাসীদের রাজ্য, জঙ্গিদের রাজ্য। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
চার রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ:
গত ২২-ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে একদল দুষ্কৃতকারী ক্যাম্প-৭ এর খেলার মাঠ এলাকার খাল পাড় দিয়ে প্রবেশ করে। তাদের মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল। দুষ্কৃতকারীরা ক্যাম্প -০৮ ইস্ট এর বি/৬৪ এর বি/৫৪ তে অবস্থানরত ৪ ব্যক্তিকে গুলি করে আহত করে। পরে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা দ্রুত স্থান করে।
রোহিঙ্গা নেতা শফিক হত্যা:
গত ২৬ ডিসেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মোহাম্মদ হোসেন প্রকাশ শফিক (৪০) নামের রোহিঙ্গা নেতা (হেড মাঝি) নিহত হয়েছেন। ঐ দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বালুখালী ক্যাম্প ৮/ইস্টে এ ঘটনা ঘটে।
বিদেশী অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটক:
গত ৩ জানুয়ারী কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ১টি বিদেশি পিস্তলও ৩রাউন্ডগুলি সহ এক সন্ত্রাসীকে আটক করে ৮আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান(এপিবিএন)। আটককৃত হলেন টেকনাফ উপজেলার হোয়্যাইকং ইউনিয়নের লম্বাবিল গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুস শুক্কুর (২৮)। আটক করে তাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়।
গুলিবিদ্ধ নবী হোসেন ও গ্রেনেড উদ্ধার:
গত শুক্রবার (৬ জানুয়ারী) দুপুরে ক্যাম্প-৮ (ইস্ট), ব্লক-বি/৩৯ এ এক হামলায় দূর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মো. নবী হোসাইন (৩৮) নামের এক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে আহত ব্যক্তির বসত ঘরে একটি গ্রেনেড সদৃস্য বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রেনেডটি দুদিন পরে রামু সেনানিবাসের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা নিষ্ক্রিয় করেন। গ্রেনেডটি কোন দেশের তৈরি তা লেখা না থাকলেও এটি অত্যাধুনিক বলে জানিয়েছে ইউনিটের সদস্যরা।
এ ঘটনায় শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন একটি মামলা করেছে। মামলায় ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি-আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি (৪৮), রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নবী হোসেন বাহিনীর প্রধান মো. নবী হোসেন (৪৫) এবং নবী হোসেন বাহিনীর সদস্য গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ নবীকে আসামি করা হয়েছে।
সাড়ে ৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুই খুন:
গত ৭ জানুয়ারি ও ৮ জানুয়ারির সাড়ে ৮ ঘন্টার ব্যবধানে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই রোহিঙ্গাকে খুন করা হয়। ৮ জাুনয়ারী দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ৮- নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের আব্দুস সোবহানের ছেলে সাব মাঝি মোহাম্মদ সেলিম (৩৫) নিহত হয়। এই ঘটনার সাড়ে ৮ ঘন্টা আগে, ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটার দিকে পালংখালীর জামতলী এফডিএমএন ক্যাম্প-১৫, ব্লক-এ/৫, এর হেড মাঝি রশিদ আহমদ কে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত কয়েক দিনে আরসা সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবিরে কয়েকজন মাঝিকে বসতঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে কিংবা কুপিয়ে হত্যা করে। আশ্রয়শিবিরের অন্তত ৭০০ জন মাঝি আরসার আতঙ্কে ভুগছেন। প্রাণনাশের হুমকিতে বেশ কয়েকজন মাঝি ইতিমধ্যে আশ্রয়শিবির ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে মাঝি আছেন প্রায় আড়াই হাজার।
নিরাপত্তাহীনতায় ৭০০ মাঝি:
উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত প্রায় ৭০০ মাঝি নিরাপত্তাহীনতায় জীবন পার করছে অনেক দিন ধরে। আবার অনেক রোহিঙ্গা নেতারা রয়েছে আত্মগোপনে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তাঁদেরকে পেলে আরসার লোকেরা গুলি করে মারবে বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। আত্মগোপনে চলে যাওয়া কয়েকজন মাঝি জানান, আশ্রয়শিবিরের মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে আরসা বাহিনী। এতে জড়িত বেশ কয়েকজন মাঝি। আরসা মাঝিদের হত্যার ‘মিশনে’ নেমেছে।
৮এপিবিএনের মুখপাত্র ও সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, আশ্রয় শিবিরে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান চলছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।