ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড: পানি ও খাদ্যের জন্য হাহাকার অবস্থা রোহিঙ্গাদের

কক্সবাজার
  © মোমেন্টস ফটো

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে আসছে ২০১৮ সাল থেকে। এইরকম অগ্নিকান্ডের ঘটনা রোহিঙ্গাদের কাছে খুব পরিচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুরেফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী এমন নানা প্রশ্নও জেগেছে স্থানীয় সচেতন মহলের। প্রতিবার অগ্নিতকান্ডের ঘটনার সাথে সাথে পানি ও খাদ্যের অভাবে হাহাকার অবস্থায় পড়ে রোহিঙ্গারা।

সদ্য ঘটে যাওয়া উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। "ঘুরেফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী" এসব প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টায় নেমেছে তদন্ত কমিটি। আগামি ৩ দিনের মধ্যে কারণ বের করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান।

তিনি বলেন, তাকে প্রধান করে ৭ জনের গঠিত কমিটিতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস, এপিবিএন, পুলিশ সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা সদস্য রয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয় শিবিরে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।

অতীতের মত এবারও উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী আশ্রয় শিবিরে রোববার (৫ মার্চ) দুপুরে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১১টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকাণ্ডে ক্যাম্পের দুই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়। তাতে প্রায় ১২ হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। 

সোমবার সকালে ক্যাস্পে গিয়ে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের পর ৯, ১০ ও ১১নং ৩টি ক্যাম্প পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চারদিকে ছাই আর ছাই। ধ্বংসস্তূপের ওপর শুধু ইট-পাথরের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ছাই সরিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজে দেখছেন। কেউ কেউ ঘরের দখল ধরে রাখতে পুড়ে যাওয়া ঘরের ওপরই বসে আছেন। পানি আর খাদ্যের জন্য হাহাকার অবস্থা।

একইদিন সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ, এপিবিএনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত নাশকতা বলে দাবি করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হয়েছে।

শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাশন কমিশনারের এক তথ্য বলছে, প্রাথমিক অবস্থায় ২ হাজারের মত ঘর পুড়েছে। যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১২ হাজার রোহিঙ্গা। পুড়ে যাওয়ার মধ্যে ৩৫টি মসজিদ-মক্তব, ২টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হেল্প পোষ্ট একটি, যুব কেন্দ্র ১টি, নারী বান্ধব কেন্দ্র ১টি, শিক্ষা কেন্দ্র ১টি, শিশু বান্ধব কেন্দ্র ১টি, মানসিক পরিচার্যা কেন্দ্র ১টি পুড়ে গেছে। এপর্যন্ত হতাহতের কোন তথ্যও পাওয়া যায়নি।

রোহিঙ্গা মাঝি আব্দু শফি দাবি করেছেন, ১১, ৯ ও ১০ নং ক্যাম্পের ৮টি ব্লকের কয়েক হাজার ঘর ইতোমধ্যে পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এই ক্যাম্পগুলোর কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে আছে। আমাদের যদি একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে না দেয় গরমের কারণে অনেক রোহিঙ্গা অসুস্থ হয়ে পরবে। কাল থেকে অনেকে "ভাতের দানাও" চোখে দেখেনি। 

৮ এবিপিএন এর সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, “রোববার বিকালে হঠাৎ করে ক্যাম্পে আগুন দেখা যায়। কিভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ক্যাম্পের ঘরগুলো পাশাপাশি হওয়ায় আগুন ১২, ১১, ১০ ও ৯ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সন্দেহজনক এক যুবকে আটক করেছে এপিবিএন ও পুলিশ।

কক্সবাজারস্থ অতিরিক্ত শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা জানিয়েছেন, 
অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ঘর পুড়েছে, ২২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৩৫ টি মসজিদ, বিভিন্ন এনজিও সংস্থার স্কুল এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসহ ৫২ টি স্থাপনা পুড়ে গেছে।”

শরণার্থী ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি সবাই নাশকতা বললেও নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাবেনা। তিনি বলেন যে তদন্ত সাপেক্ষে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। নাশকতার অভিযোগে সন্দেহভাজন একজনকে আটকও করা হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, “আমরা দেখতেছি কী কারণে আগুন লেগেছে।” তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। তদন্ত শেষে সবকিছু জানা যাবে।