কালাইয়ে পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওপর আস্তা হারিয়ে ঝুঁকছেন হোমিও হলগুলোতে

কালাই
  © টিবিএম ফটো

জয়পুরহাটের কালাইয়ে গত একমাসে ছোট-বড় মিলে প্রায় পাঁচ শতাধিক গরুর শরীরে দেখা দিয়েছে লাম্পি স্কিন রোগ। ইতিমধ্যে মারাও গেছে অর্ধশতাধিক গরু। এ রোগ র্নিমূলে কোনো চিকিৎসাও মিলছেনা পশু হাসপাতালে। অফিস সময়ে তাদের পশু হাসপাতালে পাওয়া না গেলেও টাকার বিনিময়ে ঠিকই বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ খামারী ও কৃষকদের।  

এসব কারণে স্থানীয় পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওপর আস্তা হারিয়ে খামারী ও কৃষকরা গরুকে বাঁচাতে ছুটছেন স্থানীয় হোমিও হলগুলোতে। নিজেরা না খেয়ে গরুকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই তারা বেঁচে নিয়েছে এ পথ। অল্প খরচে হোমিও চিকিৎসা নিয়ে ইতিমধ্যে ভালও হয়েছে অনেক গরু। হোমিও হলগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে খামারী ও কৃষকদের ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। 

পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে এলাকার কিছু হাতুরি পশু চিকিৎসকরা নিজেদের চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে খামারী ও কৃষকদের নিকট থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।যেনতেন চিকিৎসা দিয়ে ভিজিট বাবদ গুণতে হচ্ছে ৫০০-১০০০ টাকা।   

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে খামারী ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ রোগের কারণে প্রতিদিন আক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরুর শরীরে বড় বড় চাকা ও ঘায়ের মতো ক্ষত দেখা দিয়েছে। সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক গরু মারাও গেছে। বর্তমানে এলাকার প্রত্যকের বাড়ীতে এ রোগে আক্রান্ত গরু আছে বলে জানা গেছে। পশু হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের সময়মত পাওয়াও যাচ্ছেনা। টাকার বিনিময়ে তারা অফিস সময়ে বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করছেন অথচ তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। গরু নিয়ে বিপাকে পড়ে খামারী ও কৃষকরা স্থানীয় পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওপর আস্তা হারিয়ে এখন হোমিও হলগুলোতে গিয়ে গরুর চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, গত একমাসে উপজেলার পাঁচগ্রামের কৃষক নজির উদ্দিনের ২টি, একই গ্রামের মামুনুর রশিদের ১টি, মাদাই গ্রামের হাফিজুলের ২টি, শিকটা গ্রামের আব্দুল লতিফের ১টি, শুকটিগাড়ি গ্রামের খলিলুর রহমানের ১টি, বড়ইপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ২টি, শ্রীপুর গ্রামের মনতাজ উদ্দিনের ১টি, জামুড়া গ্রামের আব্দুল লতিফের ১টি, বেগুন গ্রামের আকবর আলীর ১টি, একই গ্রামের রাবেয়া বিবির ১টি, মাহমুদুল হাসানের ২টি, শফিকুল ইসলামের ১টি, টাকাহুত গ্রামের মমতাজ উদ্দিনের ১টি, পুরগ্রামের মিলন রহমানের ২টি একই গ্রামের মিজানুর রহমানের ২টি গরু, চেচুরিয়া গ্রামের আবু হাসানের ১টি, কালাই পৌরসভার কাজীপাড়া মহল্লার তারেক রহমানের ১টি, ধাপ-কাথাইল মহল্লার শফিকুল ইসলামের ১টি, একই মহল্লার শ্রী সুমন্ত এবং উজ্জল হোসেনের ২টি, মুলগ্রামের ভাদু মিয়ার ২টি গরু মারা গেছে। নাম না জানা আরও অনেকেরই গরু মারা গেছে। সেই সাথে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পাঁচশতাধিক গরু। প্রতিদিন এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ রোগের আতঙ্কে কৃষক ও খামারীরা তাদের রোগাক্রান্ত গরু কম দামে বিক্রি করছেন। এ সুযোগে অধিক লাভের আশায় স্থানীয় কসাইরা রাতের আধাঁরে এসব রোগাক্রান্ত গরু কিনে এনে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে মাংস বিক্রি করছেন। অথচ নিয়ম আছে গরু জবাইয়ের আগে ডাক্টারি সার্টিফিকেট প্রদর্শন করতে হবে প্রসাশনের নিকটে। কিন্তু এসবের খোঁজ রাখে কে।  

পাঁচগ্রামের এক নারী খামারি রাবেয়া সুলতানা। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষিত নারী। লেখাপড়া করে বিএ পাস করেছি। চাকরি হয়নি। বাবা-মা বিয়ে দিয়েছে। স্বামীর সংসারে এসে ৫টি গরু দিয়ে একটি খামার করেছি। এর মধ্যে ১টি মারা গেছে আর ২টি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গরু নিয়ে পশু হাসপাতালে গেলে ডাক্টার পাইনা। পিওনরা বলে, স্যার বাহিরে আছে। বাধ্য হয়ে হোমিও চিকিৎসা নিয়েছি। বর্তমানে গরুগুলো ভালই আছে। 
 
শ্রীপুর গ্রামের কৃষক মনতাজ উদ্দিন বলেন, আমি একজন কৃষক মানুষ। জমি চাষের পাশাপাশি বাড়ীতে ২টি গরু লালণ-পালণ করছি। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে ১টি গরু মারা গেছে। আর একটি আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছে। পশু হাসপাতালে গিয়ে ডাক্টারকে না পেয়ে বাড়ীতে এসে এলাকার এক হাতুরি ডাক্টার দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। কই ভালো তো হচ্ছেনা। গরুটি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কি হবে জানিনা। 

জিন্দারপুর গ্রামের বাসিন্দা ইমতিয়াজ বলেন, দুটি গরুর মধ্যে একটি রোগাক্রান্ত ছিল। সেই গরু মহেশপুর বাজারের এক কসাইয়ের নিকট বিক্রি করেছি। গত বৃহস্পতিবার রাতে ভটভটি যোগে নিয়ে গেছে। জবাই করেছে কি না তা আমার জানা নেই। 

পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে অবস্থিত ফাহিম হোমিও হলের চিকিৎসক কামরুল হাসান বলেন, লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন অনেকেই আসছেন। আরসেনিক এ্যালবাম, মেলেনড্রিনাম, এ্যাপিসমেল ওয়ান এম সাথে বেলেডোনা ও রাজস্টক ওয়ান এম ডোজে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ গরুই ভালো হয়েছে। যাদের অবস্থা একেবারে খারাপ হয়েছে সেসব গরুর মধ্যে ২/১টি মারা গেছে। এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক পশুর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।    

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হাসান আলী বলেন, সারা দেশে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। কালাইয়েও দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েকটি গরু মারাও গেছে। এ কারণে আমাদের চাপও বেড়েছে। রোগীর চাপে অনেকেই হোমিও চিকিৎসা নিতে পারে, তবে তা আমার জানা নেই। সময়মত ভ্যাকসিন নিলেই এ রোগ আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা সবসময় খামারি ও কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছি। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা তিথি বলেন, পশু হাসপাতালে জনবল সংকটের কারনেই মুলত চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। গত মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রোগাক্রান্ত গরুর মাংস বাজারে বিক্রি হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছেও খবর এসেছে, তবে এ বিষয় নজরদারি করতে সকল জনপ্রতিনিধিকে অনুরোধ করা হয়েছে।