হাসেম-মুরাদ সিন্ডিকেট: টোকেন বানিজ্যের স্লোগান দিয়েছে "মাদককে না বলুন"
- কনক বড়ুয়া, উখিয়া:
- প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৯ AM , আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪, ০১:৫৭ AM

"মাদককে না বলুন" স্লোগান যুক্ত তিন ইঞ্চির কাগজ দিয়েই চলছে মরিচ্যা সিএনজি সমিতির টোকেন বানিজ্য। যদিও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সবধরনের ই-বাইক(টমটম) ও লাইসেন্স বিহীন অবৈধ যান চলাচলের ওপর। এই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে উখিয়ার মরিচ্যা সিএনজি সমিতির নিয়ন্ত্রিত শত শত অবৈধ রেজিস্ট্রেশন বিহীন (নম্বরবিহীন) সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ও ই-বাইক এই সিন্ডিকেটের দেয়া বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে দেদারছে চলাচল করছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযানে দু’চারটি নম্বরবিহীন অটোরিক্সা আটক হলেও অদৃশ্য কারণে অভিযানগুলো থেমে যায়! ফলে এই সমিতির নম্বরবিহীন অটোরিক্সা চলাচলে বাধা থাকছে না কোথাও।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে নামে এই টিম। উঠে আসে উখিয়ার মরিচ্যা সমিতি নিয়ন্ত্রিত ১২ টি পার্কিংয়ের টোকেন বাণিজ্যের হাসেম-মুরাদসহ টোকেন সিন্ডিকেটের প্রায় ১১ জনের নাম। জানা গেছে, এইসব পার্কিংয়ে অবৈধ গাড়িগুলো চলছে বিশেষ টোকেন’র মাধ্যমে। টোকেন বাণিজ্য করে মাসে হাজার হাজার ও বছরে লাখ টাকারও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। অবৈধ এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে সাহস যেন কারই নেই!
এছাড়াও অনুসন্ধানে আরো উঠে আসে সমিতিতে নেতৃত্বের সাইনবোর্ড দিয়ে অনেকেই দেদারছে করছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। কমিটির নির্দিষ্ট সময় শেষে নির্বাচন আসলেই লাখ লাখ টাকা খরচ করে পদ পদবীর মিশনে নামে এসব সিন্ডিকেট। নির্বাচনে প্রধান পদ সিন্ডিকেটের বাইরে কাউকে দখল করতে দেয়না টাকার জোরে।
মরিচ্যা বাজারের গোয়ালিয়া, রুমখা বউবাজার, কোটবাজার, পাতাবাড়ি, রামু, কক্সবাজার, উত্তর বড়বিল, থোয়াইংগাকাটাসহ বিভিন্ন সিএনজি-টমটম স্ট্যান্ড ঘুরে পরিচয় গোপন রেখে চালক ও ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোডে স্টিকার ছাড়া কোনো গাড়ি চলাচল করলে ট্রাফিক বা হাইওয়ে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়। স্টিকার থাকলে গাড়ির লাইসেন্স অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও আটকানো হয় না।
জানা যায়, এই সড়কগুলোতে রেজিস্টেশনবিহীন অটোরিক্সা চলতে প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সা বা ই-বাইককে (টমটম) প্রতি মাসে কিনতে হয় ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকার টোকেন। আদায়কৃত এই চাঁদা থেকে নম্বর ও রেজিষ্ট্রেশনবিহীন অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা চলাচলের জন্য কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করা হয়ে থাকে বলে বিশ্বস্থ একটি সূত্র তা নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, সিএনজি সমিতি ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে সক্ষতা থাকায় এই টোকেন বাণিজ্যের হোতাদের অবৈধ এ বাণিজ্য আজো বন্ধ হচ্ছে না। এদিকে এই সব রেজিস্ট্রেশন বিহীন (অনটেস্ট) সিএনজি অটোরিক্সা ও ই-বাইকের (টমটম) টোকেন ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করে নিজেরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অন্যদিকে এই টাকা টোকেন ব্যবসায়ীরা আত্মসাৎ করেন।
মরিচ্যা বাজারসহ উখিয়ার বিভিন্ন স্টেশনে সিএনজি সহ ব্যাটারি চালিত ই-বাইকের (টমটম) একমাস পর পর নিতে হয় এই নতুন টোকেন। মরিচ্যা বাজারের প্রধান সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন দশ টাকার লাইনম্যান খরচ ও প্রতিমাসে টোকেনে মাসোয়ারার নামে বানিজ্য অব্যাহত রেখেছেন। মরিচ্যাতে সর্বমোট ১২ টি সিএনজি ও টমটম (ই-বাইক) পার্কিং আছে। তারমধ্যে টমটম পার্কিং ৭ টি ও সিএনজি পার্কিং ৫ টি। এসব পার্কিং থেকে লাইন খরচের নামে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মরিচ্যা সিএনজি সমিতির হাসেম-মুরাদ সিন্ডিকেট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কজন চালক ক্ষোভের ভাষায় জানান- 'মরিচ্যাতে সিএনজি-টমটমের সব পয়েন্টে টোকেন বানিজ্য চলছে। দৈনিক একটি সিএনজি- টমটম থেকে দশ/বিশ টাকা করে দিতে হয়, না দিলে গালিগালাজ বা অপদস্ত করা হয় তাদের কে। এই স্টেশনে হাজারের অধিক সিএনজি- টমটম চলাচল করছে বলে সূত্রে প্রকাশ করেছে।
এ ব্যাপারে মরিচ্যা সিএনজি সমিতির অন্তর্ভুক্ত কয়েকজন সিএনজি ড্রাইভারের সাথে টোকেনের ব্যাপারে কথা বলে জানা যায় "হাসেম-মুরাদ" সিন্ডিকেটের টোকেন বানিজ্যের বিষয়টি সত্য। তারা এটাও বলেন- মরিচ্যা সিএনজি সমিতি থেকে প্রতিমাসে ৩০০ টাকা দিয়ে একটি টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। আবার কেউ কেউ ভাল সম্পর্কের খাতিরে ৩০০ টাকার চেয়ে কম টাকায় টোকেন সংগ্রহ করেন বলেও জানান তারা।
টোকেন বানিজ্যের ব্যাপারে মরিচ্যা সিএনজি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাছান মুরাদ জানায়- "মাদক কে না বলুন" এই স্লোগান যুক্ত টোকেনে আমরা কোন টাকা নিচ্ছিনা। বর্তমানে মাদক সেবন করা লোক বেড়ে গেছে, অনেক ড্রাইভাররা মাদক বহন করে থাকে গাড়িতে। তাই মাদক থেকে বিরত থাকতেই এই টোকেন দিচ্ছি আমরা।
হলদিয়া পালং ইউনিয়ন শাখা শ্রমিকলীগের আহবায়ক তানিম রহমান কেনাম অসহায় চালকদের পক্ষে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিনি ফেইজবুকে লিখেছেন- "এই চাঁদাবাজা হাসেম-মুরাদদের টুকেন বানিজ্য বন্ধ করতে হবে, এই মহান শোকের মাসে ও মরিচ্যা সিএনজি সমিতি টুকেন বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। এই মরিচ্যা সিএনজি সমিতিতে শতকরা ৮০% ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। অনেকের নামে ডজন ডজন ইয়াবার মামলা রয়েছে।"
মরিচ্যাতে "ট্রাফিক আইন-মরিচ্যা", " মাদককে না বলুন-মরিচ্যা" বা এইরকম বিভিন্ন লেখাযুক্ত কাগজের টুকরো দিয়ে চলছে টোকেন বানিজ্য। এমন তথ্য জানিয়ে কোটবাজার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর নাজমুলের কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি কক্সবাজার বার্তাকে জানান- "মরিচ্যা আসলে শাহপুরী পুলিশ ফাড়ি দেখেন, আমরা দেখিনা। আমরা কোটবাজার দেখি। আর ট্রাফিক আইন তো শুধু আমরা ট্রাফিক বিভাগ দেখিনা। এটা হাইওয়েও দেখে।
এ বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে উখিয়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম বলেন, হাইওয়ে পুলিশ এরকম টোকেন বানিজ্যের সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত না আর কোন ধরনের মাসিক চাঁদা নেয় না। কোন সমিতি যদি বলে মাসিক চাঁদা দিয়েছে যাকে দিয়েছে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া সড়কে অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই টোকেন বানিজ্যের ব্যাপারে সমিতির কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দিবো।