কেএনএফ আতঙ্কে উৎসব মাটি, থানচি ছাড়ছে বহু মানুষ
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৭ AM , আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৭ AM

দেশের তিন পার্বত্য জেলায় আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। সম্প্রতি বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি ব্রাঞ্চে নজিরবিহীন ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি। এরপর বৃহস্পতিবার থানচি বাজারে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলি চলে তাদের। একইদিন গভীর রাতে আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা হয় বান্দরবানের আলীকদমে; পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে।
এমন পরিস্থিতি ঈদ ও বৈসাবির আনন্দ মাটি হয়ে গেছে থানচিবাসীর। কেএনএফের হামলার ভয়ে এলাকা ছাড়ছেন বহু মানুষ। গতকাল শুক্রবার (৫ এপ্রিল) একদিনেই থানচি বাজার এলাকা থেকে বান্দরবান সদরে চলে গেছে দেড় শতাধিক পরিবার। যারা এখনও আছেন, তাদেরও দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। কেউ থাকতে চাইছেন না থানচি বাজার এলাকায়।
‘চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। ভয়ে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে প্রথমে খাটের নিচে ঢুকে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ চলে গোলাগুলি। বাইরে হইচই-আওয়াজ। সবাই পাশের জঙ্গলে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যেই বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গোলাগুলি থেকে বাঁচতে গ্রামের অন্য মানুষের সঙ্গে জঙ্গলে আশ্রয় নিই।’
কথাগুলো বান্দরবানের থানচি উপজেলার ফজলপাড়া বাজারসংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা নুরবানু বেগমের। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে। সে সময় থানচি থানা লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। জবাবে পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশ। প্রাণভয়ে থানার পাশের ফজলপাড়া, হেডম্যানপাড়া ও বাঙালিপাড়ার প্রায় ৫০০ পরিবার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। গুলির শব্দ থামার পর রাত ১০টার দিকে বাড়ি ফেরে তারা। মাঝরাতে আলীকদমে চেকপোস্টে হামলার খবর আসে। এমনিতেই রুমা ও থানচিতে তিন ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলায় আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।
তার মধ্যে থানা ও চেকপোস্টে হামলা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। গতকাল শুক্রবার থানচি থেকে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন।
গতকাল থানচির বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। বেলা ১১টার দিকে উপজেলা সদরের ব্রিজের মাথায় গিয়ে দেখা যায়, চাঁদের গাড়িতে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় যানবাহন চলাচল ছিল কম। বাঙালিপাড়ার মো. মাসুম উর ইসলাম বলেন, ‘নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছি। আপাতত বান্দরবান সদরে এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছি।’
বাসিন্দারা বলছেন, সামনেই ঈদ ও পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা তাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। উৎসবের আনন্দ হারিয়ে থানচি, রুমা ও আলীকদমের বাসিন্দাদের মনে এখন ভর করেছে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা।
শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থানচি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় ২৪০টি দোকানের মধ্যে সব মিলিয়ে মোটে ১৫টি দোকান খোলা। তালা ঝুলছে অন্য সব দোকানে। ক্রেতাশূন্য পুরো বাজার; এমনকি পাহাড়ি মানুষের উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। চারদিকে যেন চাপা এক আতঙ্ক বিরাজ করছিল। বাজার এলাকার মোড়ে মোড়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা।
থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কেএনএফের অস্ত্রের মহড়া, ব্যাংক ডাকাতি, থানায় আক্রমণ আর গোলাগুলির ঘটনায় বাজার ও আশপাশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাত নামলেই ভয় বেড়ে যাচ্ছে। দিনে পুলিশ ও বিজিবির কড়া পাহারা থাকায় রাতের অন্ধকারে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে সন্ত্রাসীরা। জীবন বাঁচাতে পাহাড়ি-বাঙালি সাবাই এখন থানচি ছাড়তে চাইছে।’
এদিকে বান্দরবানের রুমা থানার এক থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কেএনএফের অন্তত চারটি আস্তানা রয়েছে বলে জানা গেছে। আস্তানাগুলোর অবস্থান বেথেলপাড়া, কেসপাইপাড়া, ইডেনপাড়া ও মুয়ালপিপাড়ায়। তার মধ্যে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের বাড়ি ইডেনপাড়ায়। এই চার পাড়াতেই বম জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকেও রুমা বাজারের পাশে অবস্থিত বেথেলপাড়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
একইভাবে থানচি থানার এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত তংকংপাড়া। সেখান থেকেই কেএনএফ সন্ত্রাসীরা দুটি চাঁদের গাড়ি করে গিয়ে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করে। আবার ওই গাড়িতেই তারা তংকংপাড়ায় ফিরে যায়। তংকংপাড়া ছাড়াও পাশের বোডিংপাড়া, কাইন্দংপাড়া, শেরকরপাড়ায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র বলছে, রুমা ও থানচিতে ডাকাতি এবং অস্ত্র লুট করার পর গভীর জঙ্গলে না গিয়ে তাদের ঘাঁটি বমপাড়ায় অবস্থান নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। অতীতে আরেক সশস্ত্র সংগঠন জেএসএসকে দেখা গেছে, পুলিশ-সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর পর গভীর জঙ্গলে চলে যেত তারা। কিন্তু তা না করে নিজেদের ঘাঁটিতেই অবস্থান নিচ্ছে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা।
সূত্রমতে, ড্রোনের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাতে দেখা গেছে, এখনও থানচি থানার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই আত্মগোপন করে আছে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা। সংগঠিতভাবেই অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে তারা। কেএনএফের এ ধরনের তৎপরতার কারণে যেকোনো সময় আবার কোথাও তারা হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশ অবশ্য বলছে, কেএনএফকে দমনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানও জোরেশোরে চলছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘থানচিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত আরও ১০০ পুলিশ সদস্য থানা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের জবাব দিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানও জোরদার করা হয়েছে।’
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও আলীকদমে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানও জোরেশোরে চলছে। ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় ৬টি মামলা হয়েছে। থানায় আক্রমণের ঘটনায় পৃথক মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।