অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
‘আমারে বদলী করতে মন্ত্রী লাগব, এমপি দিয়ে হবে না’
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ০৩:৪০ PM , আপডেট: ০২ জুন ২০২৪, ০৬:১৫ PM

"আমারে বদলী করতে মন্ত্রী লাগব, এমপি দিয়ে হবে না। মন্ত্রীর সুপারিশ লাগব প্লাস ডিজির ইয়ে লাগব। কত উপজেলা চেয়ারম্যান কত কি কইরা লাইতাসে" এভাবেই ঔদ্ধত্বের সাথে কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম। হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে এক সেবা গ্রহীতার অসন্তোষ প্রকাশের জেরে এসব কথা বলেন তিনি।
জানা যায়, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০০৭ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বাস্তবে সেবাদানের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। ডাক্তাররা সময়মত ডিউটিতে আসেন না, সময় শেষ হবার আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। ভর্তি রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া হয় না। জরুরী বিভাগেও বেশীরভাগ সময়েই কোনো ডাক্তার থাকে না। কর্তব্য ফাঁকি দিয়ে সেসময় ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখেন অনেকেই। ফলে পিয়ন, ঝাড়ুদার আর ওয়ার্ড বয়রাই ব্যান্ডেজ, সেলাইসহ বিভিন্ন অস্ত্রোপচারও করে থাকে। বিনিময়ে তারা আবার রোগীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থও আদায় করে। রোগীদের সাথে খারাপ আচরণ এবং সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে অবহেলার মত ঘটনাও হাসপাতালে প্রায়ই ঘটে।
শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় সু্যোগ-সুবিধে থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য রোগীদের পাঠানো হয় বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এছাড়া হাসপাতালের কর্মকর্তা এবং স্টোর কিপারের বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি ক্লিনিকের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে।
শুক্রবার (৩১ মে) বিকেলে সরেজমিন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, একজন রোগী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকায় ওয়ার্ডবয় কাউসার মিয়া রোগীর হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ করছেন। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম তার টেবিলে বসে আছেন। সেসময় রোগীর সাথে থাকা এক ব্যক্তি মোহায়মিনুল ইসলামের সাথে হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যাপারে তার অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলে মন্তব্য করেন। এতে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মোহায়মিনুল ইসলাম। ঔদ্ধত্বের সাথে বলতে থাকেন, 'আমারে বদলী করতে মন্ত্রী লাগব, এমপি দিয়া অইত না। মন্ত্রীর সুপারিশ লাগব প্লাস ডিজির ইয়ে লাগব। কত উপজেলা চেয়ারম্যান আইলো গেল, কত কি কইরা লাইতাসে। কাছাকাছি যাইতে পারলে ভাল হইতো, পাঁচ হাজার টাকা দিয়া দেই রাস্তাডা আগাই দেন। আমারে সরাইলডা আগাই দিলেই অইব।"
এমন মন্তব্য করার কারণ জানতে চাইলে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম বলেন, আমি এমপির কথা বলিনি, মন্ত্রীর কথা বলেছি। মন্তব্যটি কথার আলোকে এমনি মজা করেই বলেছি। উনি যেভাবে বলেছেন উনার সাথে এভাবেই হয়তোবা বলেছি।
এদিকে, শুক্রবার (৩১ মে) সকাল ৮.৩০ মিনিটে চৌদ্দমাস বয়সী শিশু মো. রমজান মিয়া পুকুরের পানিতে ডুবে যায়। পরিবারের লোকজন শিশুটিকে উদ্ধার করে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগ নিয়ে আসে। সেখান থেকে ইসিজি করার জন্য শিশুটিকে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়।
ইসিজি রিপোর্ট দেখে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম শিশুটিকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। পরে মোহায়মিনুল ইসলামের স্বাক্ষরিত জরুরী বিভাগের একটি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শিশুটির অভিভাবকরা মৃতদেহ নিয়ে চলে যান।
এই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন গণমাধ্যমকর্মী দুপুরে হাসপাতালে যান। সেসময় হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ মোন্তাসির মামুন হৃদয়। তাকে হাসপাতালে না পেয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সকালে শিশু মৃত্যুর বিষয়ে অবগত নই, ঐ সময়ে ডাঃ শফিকুল ইসলাম জরুরী বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ডাঃ শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি এব্যাপারে অবগত নই, সকাল ৮ টা পর্যন্ত আমি জরুরী বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম, ৮ টার পরে ডাঃ মোন্তাসির দায়িত্বে ছিলেন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ অভিজিৎ রায়ের কাছে এব্যাপারে জানতে চাইলে তিনিও বিষয়টি জানেন না বলে জানান। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে ডা. অভিজিৎ রায় ঐ গণমাধ্যমকর্মীকে বলেন, “ঐ সময় ডাঃ মোন্তাসির দায়িত্বে ছিলেন। ডাক্তারের অজ্ঞাতসারে এমনটা হওয়ার কথা না। ডাক্তারের সেটা জানা থাকার কথা, ডাক্তার জানবে না কেন?”
এ বিষয়ে ভোগান্তির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বায়জিদ ইসলাম অভি নামে একজন বলেন, 'জরুরী বিভাগে যারা কাজ করে তাদের ব্যবহার অনেক খারাপ। আর কোনো ধরণের সামান্য কিছু চিকিৎসা করলে তাদের টাকা দিতে হয়। যদি টাকা না দেয় অনেক বাজে ব্যবহার করে আমি তার ভুক্তভুগী।'
শাউরিয়া চৌধুরী ইমন জানান, 'আমাদের সদরের হাসপাতালের নার্স এমন সাংঘাতিক অবস্থা যা বলার মত না তাদের সাথে কোনো বিষয়ে ২য় বার কথা বলা যায়না।'
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফরহাদ বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান সন্তোষজনক নয়। সরকারি ডাক্তাররা ব্যক্তিগত চেম্বারকে বেশি গুরুত্ব দেন। তারা হাসপাতালে যখন খুশি আসেন, যখন ইচ্ছে চলে যান। লোকমুখে শুনেছি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায় তার ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানায় অংশীদার আছেন। একই ডায়াগনস্টিকের অংশীদার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত ভান্ডার রক্ষক জামাল আহমেদও। তিনি ব্যবহার করেছেন শ্বশুরের নাম।
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত ভান্ডার রক্ষক জামাল আহমেদ বলেন, “আমার শ্বশুর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানায় অংশীদার আছেন। তিনি নিয়মিত সেখানে বসেন, এর সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই”।
বেসরকারি ক্লিনিকের সাথে সম্পৃক্ততা ও অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায় বলেন, ফোনে সবকিছু বলা যাবে না, আপনি সরাসরি এসে দেখা করেন।
পরবর্তীতে ব্রাহ্মণাড়িয়ার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের পরিচয় দিয়ে মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ মাহমুদুল হাসান প্রতিবেদকের কাছে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যাপারে কি কি অভিযোগ রয়েছে তা জানতে চান। অভিযোগগুলো শোনার পর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিবেদনটি করলে জেলার মান ক্ষুণ্ণ হবে, আপনি একটু চিন্তা কইরা দেইখেন প্রতিবেদনটি আপনি করবেন কিনা। এটা আপনার উপর ছেড়ে দিলাম, নিউজের বিষয়ে আপনি যেডা ভালো মনে করেন অইডাই কইরেন”।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি আপনার মাধ্যমে বিষয়টা জানলাম। আমি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলব। আপনি যেই অনিয়মের বিষয়গুলো বললেন সেগুলো আসলেই অনিয়ম। এগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না। এগুলো নিয়ে আমি কাজ করব। এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।