গুলিবিদ্ধ স্বামীর চিকিৎসা করাতে সন্তান বিক্রি, চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন ইউএনও

হাসপাতাল
  © ফাইল ফটো

দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন দিনমজুর আব্দুর রশিদ (২৮) ৷ সে সময় স্থানীয়দের সহায়তায় প্রাথমিক চিকিৎসায় বেঁচে ফিরলেও অর্থাভাবে থমকে যায় চিকিৎসা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্বামীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানের জন্য তার স্ত্রী তিনদিনের কন্যা শিশুকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেন। সন্তান বিক্রি করা টাকা দিয়ে পুনরায় শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু সেই টাকাও শেষ হয়ে যায় খুব দ্রুতই। একদিকে টাকার অভাব ও অন্যদিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব (জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র) না থাকায় মেলেনি কোনো আর্থিক সাহায্য। অবশেষে সেই গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি জানতে পেরে যথাযথ দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নাগরিকত্ব প্রদানপূর্বক চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিলেন তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন। 

রোববার (১৬ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে আহত আব্দুর রশিদকে নিজেই তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ফজলে রাব্বি। আহতের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শে ওষুধপত্রসহ বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করেন। তিনি উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করেন টেস্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং সব ব্যয়ভার নিজেই বহন করবেন বলে ঘোষণা দেন। 

জানা যায়, এর আগে গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদের কোনো জন্মসনদ বা নাগরিকত্ব সনদ না থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে তাৎক্ষনিকভাবে জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ইউএনও। গুলিবিদ্ধ, আহত ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়া দিনমজুর আব্দুর রশিদের স্থায়ী ঠিকানা উদ্ধারের জন্য তার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন তিনি। বিভিন্ন প্রচেষ্টায় জানা যায় তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে এই গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদ। তবে গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ট্রাক্টর শ্রমিক হিসাবে কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিলেন তিনি। 

তথ্য জানা মাত্রই শুরু হয় দাপ্তরিক কার্যক্রম। আব্দুর রশিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে উপস্থিত হন তিনি। অপর একটি দল চলে যায় আব্দুর রহমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের বাড়িতে। খবর পাওয়া মাত্রই আব্দুর রহমানের বাবা নজরুল ইসলাম, কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ স্থানীয় জনগণ উপস্থিত হন সেখানে। আর এ ঘটনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলে উৎসুক জনতার ভিড়। সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আব্দুর রশিদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি, মিসবাহ উল্লাহ, হযরত আলী, মোকাদ্দেসুর রহমানসহ কয়েকজনের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং আব্দুর রশিদের জটিলতা নিরসনে ইউএনও কে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে দেখা যায়।   

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আব্দুল রশিদের মা (রশিদা বেগম) গত প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান। বাবা নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিভিন্ন বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় একসময় ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আব্দুর রশিদ। পরবর্তীতে দিনাজপুর জেলার রাজবাড়ী এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। 

গেল ৪ আগস্ট দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন আব্দুর রশিদ। তার বক্তব্য অনুযায়ী,  হাসপাতালের গেটে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজনের সহায়তায় চিকিৎসা করা হয় তার, কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি। অর্থাভাব ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর বাচ্চা প্রসবের সময় যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থান অবনতি বাড়তে থাকে। ৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি এবং সেখানে পরদিন শুক্রবার তার অপারেশন হয়। অপরদিকে তার পরদিন শনিবার রাজবাড়ী এলাকার বাড়িতে আব্দুস রশিদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম নীরবে নিভৃতে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।