বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

মেয়ের খাবার কিনতে বের হন বাবা, বুলেট এসে লাগে মাথায়

আন্দোলনে
  © সংগৃৃহীত

মেয়ের জন্য খাবার কিনতে বের হয়ে আর ঘরে ফেরা হলো না শহিদ শাহাবুদ্দিনের। গত পাঁচ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা থানার সামনের চৌরাস্তায় পুলিশের একটি দল এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। ওই সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সিএনজি চালক শাহাবুদ্দিন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত আটটার দিকে তিনি মারা যান।

শাহাবুদ্দিন ভোলা সদর উপজেলার চর সামাইয়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড এলাকার আবুল কালামের বড় ছেলে। তার মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। শহিদ শাহাবুদ্দিন রাজধানীর শেরেবাংলা থানার সামনের চৌরাস্তা সংলগ্ন আনিসের বস্তির একটি ঘরে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মা এবং ছোট বোনকে নিয়ে যৌথভাবে বসবাস করতেন। 

কবে হিজবুল্লাহ প্রধানকে হত্যার পরিকল্পনা করে ইসরায়েল? কবে হিজবুল্লাহ প্রধানকে হত্যার পরিকল্পনা করে ইসরায়েল? 
বস্তিতে তার বাবা আবুল কালামের ক্ষুদ্র ভাতের হোটেল ও নিজে সিএনজি চালিয়ে যা আয় করতেন তাতে মোটামুটি ভালোভাবেই চলে যেত তাদের পরিবার। কিন্তু শাহাবুদ্দিন শহিদ হওয়ায় পরিবারের ছন্দপতন ঘটে। তার মৃত্যুর পর গত কয়েকদিন আগে পারিবারিক কারণে পরিবারের সবাই ভোলা সদরের গ্রামের বাড়িতে চলে যান।

শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী বিবি হালিমা বলেন, গত পাঁচ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীতে থমথমে অবস্থা ছিল। আমার স্বামী সিএনজি চালানোর জন্য  সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু রাজধানীর পরিস্থিতি খারাপ থাকায়  সিএনজির মালিক গাড়ি নিয়ে বের হতে নিষেধ করে। সারাদিন ঘরেই ছিল। সন্ধ্যার আগে যখন প্রচুর গোলাগুলি  হয়, তখন একবার ঘর থেকে বের হয়ে বাবার দোকানে গিয়ে একটি দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে, দোকান বন্ধ করে তোমরা সবাই ঘরে চলে যাও। বলে সেও ঘরে ফিরে আসে।

বিবি হালিমা বলেন, শাহাবুদ্দিন ঘরে আসলে তাদের ছোট মেয়ে সানজিদা বাবার কাছে চিপস জাতীয় খাবারের বায়না ধরে। মেয়ের জন্য খাবার কিনতে বের হলে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন শাহাবুদ্দিন।  

বর্তমানে হালিমা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে লামিয়া (১৪) ও সানজিদাকে (৭) নিয়ে ভীষণ অর্থ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বিবি হালিমা তার শ্বশুরের সাথেই রয়েছেন। শ্বশুর স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হওয়ায় অর্থ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে পরিবারে। তাই সরকারি সহায়তা কামনা করেছেন এই শহিদের স্ত্রী।

শহিদ শাহাবুদ্দিনের পিতা আবুল কালাম বলেন, গত পাঁচ আগস্ট দুপুরের পর থেকেই হাসিনা সরকারের পতনের খবরে ছাত্র জনতা রাজপথে বিজয় মিছিলসহ উল্লাসে মেতে ওঠে। হঠাৎ করে সন্ধ্যার  আগ মুহূর্তে শেরেবাংলা থানার সামনের চৌরাস্তা সংলগ্ন এলাকায় একদল পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে তার ছেলে শাহাবুদ্দিনের মাথায় একটি গুলি লাগে। পরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালে রাত আটটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছেলের মৃত্যু হয়।

তিনি আরও বলেন, রাতেই তারা শাহাবুদ্দিনের মৃতদেহ নিয়ে ভোলা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পরদিন সকাল দশটায় নিজ বাড়ির সামনে জানাজা শেষে দাফন করা হয় তাকে। সেদিন পুলিশের গুলিতে আরও কয়েকজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।

শাহাবুদ্দিনের বাবা জানান, অভাবের তাড়নায় অনেক বছর আগে তিনি স্ত্রী- সন্তানদের নিয়ে ভোলা ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। এক সময় রিকশা চালিয়েছেন। এখন ছোট একটি ভাতের হোটেল দিয়েছেন। অনেক আশা ভরসা ছিল এই ছেলেকে নিয়ে। তাই শাহাবুদ্দিনের শহিদ হওয়ার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়েছেন তার বাবা।

শাহাবুদ্দিনের মা মনোয়ারা বেগম জানান, তাদের তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে শাহাবুদ্দিন ছিল সবার বড়। অন্য ছেলেরা আলাদা থাকলেও শাহাবুদ্দিন বাবা মাকে নিয়েই থাকতেন। ছেলে সব সময় বাবা মায়ের প্রতি আলাদা খেয়াল রাখত। মা-বাবার কোন কষ্ট সহ্য করতে পারতো না এই ছেলে। ছেলের এমন অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তার স্বামীর বয়স হয়েছে, সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন তাই ভাবছেন।

শাহাবুদ্দিনের ছোট বোন ফাতেমা বলেন, তার অন্য দুই ভাই ঢাকায় আলাদা থাকেন। তাদের চার বোনের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র অবিবাহিত ছোট বোন সাথী আক্তার বাবা-মা ও ভাই শাহাবুদ্দিনের সাথে ঢাকায় থাকতেন। আমরা ঢাকায় গেলে এই ভাইয়ের বাসায় গিয়েই উঠতাম।

তিনি আরো বলেন, বাবার ছোট ভাতের হোটেলের আয়ের পাশাপাশি সিএনজি চালিয়ে পরিবারের মূল আয়ের যোগান দিত ভাই শাহাবুদ্দিন। দুটি ছোট মেয়ে নিয়ে ভাইয়ের স্ত্রী খুবই সমস্যায় রয়েছেন। তাই সরকার তার পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন এমনটাই প্রত্যাশা তার।

শহিদ শাহাবুদ্দিনের বড় মেয়ে লামিয়া জানায়, তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। বাবার মৃত্যুর পরে এখন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।

তথ্য: বিএসএস নিউজ