‘আমার পোলারে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দিল, শেষবার মুখটাও দেখতে পারলাম না’

আন্দোলনে
  © সংগৃহীত

পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরতে জীবনযুদ্ধে নেমেছিলেন ফয়সাল। ছিলেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের শ্যামলী পরিবহনের বাসের সুপারভাইজার। এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ফয়সাল কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করছেন।

ফয়সালের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কাচিসাইর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের সফিউল ইসলাম ওরফে রেজা মিয়ার ছেলে। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এদিন রাতে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, ফয়সাল সরকার জিপিএ–৪.৩৫ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

ফয়সাল রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার এস এম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসিও পাস করেন তিনি। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন ফয়সাল। থাকতেন রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়।

গত ১৯ জুলাই বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন ফয়সাল। কিছুক্ষণ পর থেকেই পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইল বন্ধ পান। এর পর থেকেই খোঁজ নেই ২০ বছর বয়সী এই তরুণের। এভাবেই কেটে যায় অন্তত ১২ দিন। তার সন্ধানে দিশাহারা স্বজনেরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে জানতে পারেন, ফয়সাল আর পৃথিবীতে নেই। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে প্রাণ গেছে তার। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে নির্মম মৃত্যু হয়েছে ফয়সালের। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় ছিল, ছয় বোনসহ পরিবারের সদস্যদের আদরের ফয়সালের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই বিকেলে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয় ফয়সাল। ওই দিন সন্ধ্যার পর তার মোবাইল নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পান পরিবারের সদস্যরা। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এভাবে কেটে যায় ১২ দিন। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ১ আগস্ট বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে সেখানে কর্মরতরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখান। এরপর সেখানে ফয়সালের মরদেহের ছবি দেখতে পান স্বজনরা। 

আঞ্জুমানে কর্মরত ব্যক্তিরা পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, অন্তত ১৫টি মরদেহ একসঙ্গে গণকবর দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে ফয়সালও ছিলেন।

হোটেলের বারান্দা থেকে পড়ে ‘ওয়ান ডিরেকশন’ গায়কের মৃত্যু হোটেলের বারান্দা থেকে পড়ে ‘ওয়ান ডিরেকশন’ গায়কের মৃত্যু ফয়সাল মেধাবী ছাত্র ছিলেন। চাকরির পাশাপাশি সামান্য পড়েই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন। বাড়িতে একটি টিনের ঘর ছাড়া কিছু নেই। ফয়সাল পড়াশোনার পাশাপাশি যা আয় করতেন, তা দিয়ে পরিবার চলাতেন। আন্দোলনে ফয়সাল নিহত হওয়ায় পরিবার এখন অসহায়।

ফয়সাল এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন, এ খবর জানার পর থেকেই বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগমের কান্না থামছে না। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে মোবাইলে হাজেরা বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বারবার ছেলের জন্য আক্ষেপ করছিলেন। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাজেরা বলেন, ‘আমার পোলাডা ভালো ছাত্র আছিল। ইন্টার পরীক্ষায় পাস কইরাও দেইখ্যা যাইতে পারলো না। এই দুঃখ কেমনে সামলাইতাম। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে। আমার এত আদরের পোলাডারে বেওয়ারিশ হিসাবে কবর দিল। শেষবার পোলাডার মুখটাও দেখতে পারলাম না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ছয়ডা মাইয়ার পরে পোলাডা হয়। তার যদি ভালো একটা চাকরি হইতো সংসারডা খারায়তো। এখন কেমনে কী করবো?