একুশে ফেব্রুয়ারি
৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি আসলে ভাষার জন্য কতজন শহীদ হয়েছিলেন

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) ‘মহান শহীদ দিবস’। পুরো জাতি অমর একুশে প্রহরে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে সব বীর ভাষা শহীদদের, যাঁদের জন্য আমরা মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারছি। পাঠ্য বই থেকে মৌখিক উপস্থাপনায় ভাষা শহীদদের কথা বলতে পাঁচজনের নামই বেশি শোনা যায়। তারা হলেন- সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। তাদের মধ্যে বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন প্রিন্টিং প্রেসের মালিকের ছেলে, সালাম রিকশাচালক ও শফিউর ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী।
এই পাঁচজনের বাইরে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন, সে বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি।
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৫৩ সালে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেখানে ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যেখানে দাবি করা হয় ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন। তবে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে তৎকালীন ‘সীমান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কবিতায় চল্লিশ জন ভাষা শহীদের সংখ্যার ধারনা পাওয়া যায় ।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে পুলিশের গুলিতে যারা মারা গেছেন তাদের সবার লাশই পুলিশ নিয়ে যায়।
কবি আহমদ রফিক তার ‘একুশ থেকে একাত্তর’ বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তার ‘পাকিস্তানস আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভ্যুলুশান’ বইয়ে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মোট ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জন আহত হন বলে উল্লেখ করেছিলেন। বইটি ২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয়। তবে এ বইয়ে নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ নেই।মহান ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান। সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সেই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর ‘গায়েবি জানাজা’ পড়া হলো। পরদিন সকাল ৯টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের ওপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।’
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। খবরে বলা হয়েছে, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত: ৩ শতাধিক আহত। তাছাড়া দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।
ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’; আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবির উদ্দিন আহমদ তার ‘একুশের ইতিহাস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আটজনের মৃত্যুর কথা সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়।’ এই সূত্র ধরে এম আর আখতার মুকুল আটজন ভাষাশহীদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাটিতে ২১ ফেব্রুয়ারি রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম এবং ২২ ফেব্রুয়ারি শফিকুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, অহিউল্লাহ ও অজ্ঞাত বালককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে ভাষাশহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। ২০০০ সালে তাদের রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। রফিক , বরকত ও জব্বার তারা তিনজন নিহত হন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রাণ হারানোর তালিকায় আরো দুটি নাম পাওয়া যায়—অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে ভাষাশহিদ হিসেবে এই দুজনের নাম-পরিচয় উল্লেখ আছে। এ ছাড়া সালাউদ্দীন নামেও একজন ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একুশের শহীদ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। আর এ কারণে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পাঁচজনই ভাষাশহীদ হিসেবে সমাদৃত হচ্ছেন।
এবার দেখব সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে কী লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ২১ ফেব্রুয়ারি, ‘গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন।’ জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে।
বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।’ ২২ ফেব্রুয়ারি, তিনি লিখেছেন, ‘আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুয়ায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।’
বিভিন্ন পত্রিকা, জার্নাল আর তথ্যের উৎস থেকে গবেষনা করে প্রকৃত ভাষা শহীদের সংখ্যা আমাদের প্রজন্ম জানতে আগ্রহী। কেননা ভাষা আন্দোলনই আমাদের জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতার বীজ।