কৃষকের শ্রম-ঘামের উৎপাদিত ফসলের লাভ ভোগ করছে কারা?

বাজারে
  © ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকার বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। অথচ সেই পণ্যের উৎপাদনকারী মাঠপর্যায়ের কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষক ফসল ফলাচ্ছেন; কিন্তু ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কৃষকের শ্রম-ঘামের উৎপাদিত ফসলের লাভের পুরো অংশই নিয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব পণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে অন্তত তিন দফা হাতবদল হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেন। এ কারণেই ঢাকার সবজি বাজার আর উৎপাদন এলাকায় পণ্যের দামে বিস্তর ফারাক।

কয়েকদিন আগেও নাটোরে সবজির বাজারে বেগুন বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৫ টাকা কেজি দরে। মুলার কেজিও ২ থেকে ৫ টাকা, প্রতি পিস লাউ ৫ থেকে ৭ টাকা, শসার কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা, করলা ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি, লালশাকের আঁটি এক টাকা, ধনেপাতা ৫ থেকে ১০ টাকা কেজি। অথচ ঢাকায় এসে ভোক্তাপর্যায়ে এসব সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে গড়ে ৫ থেকে ১০ গুণের বেশি।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এক কেজি শিম উৎপাদন করতে খরচ হয় ৬ টাকা ৮৮ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি কেজি টমেটো ৯ টাকা ৬৯ পয়সা, বেগুন ১০ টাকা ২৬ পয়সা এবং প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপির উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ টাকা। প্রতিটি লাউ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১৩ টাকা ২০ পয়সা। উৎপাদন খরচ অনুযায়ী শিমের কেজি কিংবা একটি লাউয়ের দর কত হওয়া উচিত? যদি ধরা হয়, শিমের উৎপাদন খরচ ৭ টাকার সঙ্গে পরিবহন, রাস্তায় বিভিন্ন চাঁদা, আড়তের কমিশনসহ কেজিতে গড়ে ১০ টাকা খরচ আছে। তাহলে মূল খরচ দাঁড়ায় ১৭ টাকা। আর প্রতিটি লাউয়ের খরচ দাঁড়ায় ২৩ টাকা।

গতকাল শুক্রবার ঢাকার নিউমার্কেট, শ্যামবাজার, সূত্রাপুর, সেগুনবাগিচা ও কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, লম্বা বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। পাকা টমেটো ৫০ থেকে ৬০, মূলা ৩০ থেকে ৪০ এবং ফুলকপি ও বাঁধাকপির প্রতিটি মিলছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালীন সবজি ঝিঙা ৫০ থেকে ৬০, চিচিঙ্গা ৪০ থেকে ৫০, ঢ্যাঁড়শ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে গতকাল সবজির উৎপাদনস্থল বগুড়া ও নাটোরের কৃষকরা প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৫ থেকে ১০, মূলার কেজি আড়াই টাকা, প্রতিটি লাউ ৫ থেকে ১০ টাকা এবং লম্বা বেগুনের কেজি ৫ থেকে ১০ টাকার মধ্যে বিক্রি করেছেন।

বগুড়া থেকে সবজি এনে ঢাকায় বিক্রি করেন কাদের হোসেন। তার মতে, ক্ষেত থেকে সবজি নিয়ে স্থানীয় আড়তে যান কৃষক। সেখান থেকে কেনেন ব্যাপারীরা। এখানে সবজির মোট কেনা দরের সঙ্গে ৫ শতাংশ আড়তদারি দিতে হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্যে ১০৫ টাকা দিতে হয়। সবজি ট্রাকে তোলা বাবদ শ্রমিক খরচ প্রতি ট্রাকে ২ হাজার টাকার মতো। বগুড়া থেকে ঢাকায় আনতে ভাড়া লাগে ১৪ থেকে ১৭ হাজার টাকা। প্রতি ট্রাকে ১০ থেকে ১২ টন আনা যায়। ঢাকায় আনার পর প্রতি ১০০ টাকার সবজি বিক্রির বিপরীতে আড়তদারি দিতে হয় ৬ টাকা। এর মধ্যে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় চাঁদা। সরকারদলীয় নেতাদের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে চাঁদা দিতে হয়। এসব খরচ ও লাভ যোগ করে দেখা যায়, ১০০ টাকার সবজির বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।

শ্যামবাজারে খুচরা বাজারে সবজি বিক্রি করেন নুরুল ইসলাম। তার মতে, শ্যামবাজারে রাতে সবজিভর্তি কৃষকের কয়টি ট্রাক এসেছে, এ সময় ব্যাপারীরা কী পরিমাণ সবজি ট্রাকগুলোতে এসেছে এসব খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। পরিমাণে কম এলেই পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়তে থাকে। তখনই দাম বাড়াতে শুরু করে। এমনও দেখা যায়, শুরুতে যে বেগুন প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, শেষদিকে তা ৭০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের খুচরা সবজি ব্যবসায়ী আবুল বলেন, আমরা তো কমদামে সবজি বিক্রি করতে চাই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, একটা মাঝারি সাইজের লাউ পাইকারি বাজার থেকে ৫০-৬০ টাকার কম কিনতে পারি না। তার পর ঘাটে ঘাটে দিতে হয় চাঁদা; কখনো পুলিশ, কখনো নেতার লাইনম্যানকে। শ্যামবাজার থেকে ১০ হাজার টাকার সবজি কিনে নিউমার্কেট নিয়ে আসতে বাড়তি খরচ গুনতে হয় ১ হাজার টাকা। এই এক হাজার টাকা আমরা সবজির মোট দামের সঙ্গে যোগ করে তা খুচরা বিক্রি করি। এতে আমাদের লাভ থাকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এই আয়েও আমাদের সংসার চলে না।

তিনি বলেন, ‘আমাদেরও তো পরিবার আছে। তাদের কথা কেউ ভাবে?’ মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াও দাম বাড়ার পেছনে বড় কারণ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পুলিশের চাঁদাবাজিকে দায়ী করেন তিনি।

অন্যদিকে রাজধানীর শ্যামবাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতারা জানান, ফুটপাতে দোকান ভাড়া দৈনিক স্থানভেদে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের লাইনম্যানদের দৈনিক চাঁদা দিতে হয় ২০ থেকে ৫০ টাকা। পুলিশের লাইন খরচ দিতে হয় ১০০ টাকা। দৈনিক একটি বাতি জ্বালালে দিতে হয় ১০০ টাকা। এর সঙ্গে নিজের মুনাফার ভাগ। এসব যোগ করলে একটা লাউ ১০০ টাকার কমে কোনোভাবেই বিক্রি করা যায় না।

খুচরা সবজি বিক্রেতা আলিম বলেন, ফুটপাতে ব্যবসা করলেও দৈনিক অতিরিক্ত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ আছে। এর ভাগ যায় পুলিশ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় নেতাদের পকেটে।