রপ্তানিতে প্রণোদনা আরও কমলো, খরচ বাড়ার আশঙ্কা 

রফতানি
  © সংগৃহীত

নতুন অর্থবছরের প্রথম দিনে আরও কমলো রফতানিতে নগদ প্রণোদনা। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে চূড়ান্তভাবে বের হওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে রফতানিমুখী ৪৩টি খাতে নগদ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সর্বাধিক প্রণোদনা পাওয়া পোশাক খাতের প্রণোদনার হার ০.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের সফটওয়্যার ও আইটিএস রফতানি প্রণোদনা ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে আড়াই (২.৫) শতাংশ।

আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে  উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশের। এজন্য বেসরকারি খাতকে প্রস্তুত করতে সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাঁচ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো কমলো প্রায় সব রফতানিতে নগদ সহায়তা।
 
রোববার (৩০ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তৈরি পোশাক খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনার হার ০.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩ শতাংশ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে যা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা হয়।
 
নিট, ওভেন ও সোয়েটারসহ তৈরি পোশাক খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অতিরিক্ত নগদ সহায়তা হবে ৩ শতাংশ, যা আগে ছিল ৪ শতাংশ। বস্ত্র খাতে নতুন পণ্য বা নতুন বাজার সম্প্রসারণ সুবিধা ২ শতাংশে নামানো হয়েছে, যা এর আগে ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়।

বৈচিত্র্যপূর্ণ পাটপণ্যে নগদ সহায়তা আরও কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে; আগে যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। পাটজাত চূড়ান্ত দ্রব্যে এ সহায়তা করা হয়েছে ৫ শতাংশ; আগে যা ১২ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছিল। আর চামড়াজাত দ্রব্য রফতানিতে প্রণোদনার হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে; ফেব্রুয়ারির আগে যা ছিল ১৫ শতাংশ।
 
ওষুধের কাঁচামালে নগদ সহায়তা মিলবে ৫ শতাংশ; এর আগে যা ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামানো হয়। শতভাগ হালাল মাংস রফতানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হবে; এর আগে যা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ হয়েছিল। কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং আলু রফতানিতে সহায়তা আরও কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
 
হাল্কা প্রকৌশল রফতানিতে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশে নামানো হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে যা ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হয়। এখন থেকে ৬ শতাংশ নগদ সহায়তা পাবে মোটরসাইকেল, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য, রেজার ও রেজার ব্লেড, কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক দ্রব্য ও হাতে তৈরি পণ্য। তবে সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যারে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সগদ সহায়তা ৬ শতাংশ করা হয়েছে; যদিও ফেব্রুয়ারির আগে ছিল ১০ শতাংশ।
 
নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন, অর্থাৎ সোমবার (১ জুলাই) থেকে কার্যকর হচ্ছে এ প্রজ্ঞাপন, যা ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে।

হ্রাসকৃত হার পুনর্বিবেচনার দাবি রপ্তানিকারকদের:
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন– বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এখন প্রণোদনা হ্রাসের সময় না। এতে স্থানীয় স্পিনিং মিলসহ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার জন্য আবেদন করতে প্রণোদনার তুলনায় বেশি খরচ পড়ে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, "সরাসরি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের ওপর প্রণোদনা দেওয়া হলে আমাদের হয়রানি কিছুটা হলেও কমবে।"

বিকেএমইএ'র এই নেতা জানান, এখন আমাদের আমদানি খরচ আরও বাড়বে, কারণ "প্রণোদনা হ্রাসের কারণে আমরা কাঁচামাল আমদানি করতে বাধ্য হব।" প্রণোদনা এখন না কমিয়ে ২০২৫ বা ২০২৬ সালেও কমানো যেত বলেও মনে করেন তিনি।

একারণে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে হাতেম বলেন, "গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে এবং একইসঙ্গে ব্যাংক লোনের সুদের হারও বেড়েছে। ফলে আমাদের খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।"

পোশাক শিল্পের শীর্ষ সংগঠন– বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা ব্যাপকবভাবে কমানো হয়েছে।  "এখন আমরা রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাব। আগের ইনসেনটিভ রেট অনুযায়ী আমরা অনেকগুলো অর্ডার নিয়েছি, ফলে আমাদের ক্ষতি হবে। এই সময়ে এক্সপোর্ট অর্ডারের পরিমাণ বাড়াতে, মার্কেটে টিকে থাকতে, কম্পিটিটিভ থাকার জন্য প্রণোদনা যেন না কমে সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত" বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিজিএমইএয়ের পরিচালক এবং ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "আমাদের জন্য বিকল্প সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে এভাবে ক্রমান্বয়ে প্রণোদনা কর্তন করলে – আমাদের টিকে থাকাটা আরও কষ্টকর হবে। প্রণোদনা হার কমিয়ে আনা হচ্ছে; তবে আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। ইন্ডিয়া, চায়না, ভিয়েতনামে এই শিল্প সরকারের থেকে যে ধরনের নীতিগত সুবিধা পেয়ে থাকে – সেগুলো বিবেচনায় এনে আমাদের দেশেও চালু করতে হবে।" 

বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, "অর্থনীতি এখন প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে, এরমধ্যে আমাদের দেশের রপ্তানির সুবিধা কমানো হচ্ছে, যার আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।" ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, "আমাদের ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই প্রণোদনা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।"

গবেষণা প্রতিষ্ঠান– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রণোদনা কমিয়ে আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, "ব্যবসায়ীরা এক সময় রপ্তানি আয়ের ডলারের দাম ৮৬ টাকা পেত, এখন তা ১১৮ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। আমি মনে করি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় রপ্তানিকারকরা বেশ লাভবান হয়েছে।"

"ব্যবসায়ীরা যে সমস্যায় রয়েছে এটা মানতে হবে। কারণ এক বছর আগেও ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পেত, এখন তা ১৪ শতাংশ। সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীদের খরচও বেড়ে গেছে। তবে সরকার প্রণেদানা কমালে– রপ্তানিকারকদের অন্যভাবে সহায়তা করতে হবে।" 

"আমাদের রপ্তানিকারকদের অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রপ্তানি পণ্য পরিবহনে তাদের খরচ বেশি হয়। এছাড়া এসব ব্যবসায়ীদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা পাওয়া আরও সহজ করতে হবে। একইসঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা কীভাবে বাড়ানো যায়– সেদিকে উদ্যোগ নিতে হবে" – যোগ করেন মুস্তাফিজুর। 


মন্তব্য