তীব্র গ্যাস সংকটে সিরামিক উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে

গ্যাস
  © সংগৃহীত

দেশব্যাপী চলমান গ্যাসসংকটে সিরামিকশিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এতে করে এই খাতের দৈনিক উৎপাদন ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি টাকা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে যেখানে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা, সেখানে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তা কমে মাত্র দুই থেকে তিন পিএসআইতে নেমে এসেছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় পিএসআই শূন্যতে নেমে গেছে।

গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। সিরামিকশিল্প রক্ষায় গ্যাসসংকট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে।

বিসিএমইএর সভাপতি ও সংসদ সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘গ্যাসসংকটের কারণে আমাদের নরসিংদী ও গাজীপুরের বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ আছে। এতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। এক মাস ধরে এই অবস্থা চলছে। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে প্রধান জ্বালানিই হচ্ছে গ্যাস। গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকলে সিরামিক পণ্য উৎপাদন করা হলেও পণ্যের মান ঠিক থাকে না। এতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদেশি কম্পানিগুলো অর্ডার বাতিল করে দেয়।’

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিসিএমইএর চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রায় এক মাস ধরে ঢাকার মিরপুর-১২, সাভার, ধামরাই, গাজীপুরের টঙ্গী, কাশিমপুর, ভবানীপুর, ভাওয়াল মির্জাপুর, শ্রীপুর, মাওনা, নরসিংদীর পাঁচদোনা, ময়মনসিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল এলাকায় তীব্র গ্যাসসংকট চলছে। এসব এলাকায় অবস্থিত ২২ থেকে ২৫টি সিরামিক তৈজসপত্র, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও সিরামিক ব্রিকস কারখানার উৎপাদনকাজ ব্যাহত হচ্ছে। যেখানে ১৫ পিএআই প্রেসার প্রয়োজন, সেখানে গ্যাসের প্রেসার কখনো কখনো দুই বা তিন পিএসআই থেকে শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে। এতে করে প্রতিদিন ওই সব এলাকায় উৎপাদন ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি টাকা।

বিসিএমইএর তথ্য মতে, সিরামিক খাতে টেবিলওয়্যার, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও ব্রিকসের ৭০টিরও বেশি কারখানা রয়েছে। দেশি-বিদেশি মোট বিনিয়োগ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের বাজারের চাহিদার ৮৫ শতাংশই দেশীয় কম্পানিগুলো পূরণ করছে। একই সঙ্গে বিশ্বের ৫০টি দেশে সিরামিক পণ্য রপ্তানি করে বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। গত ১০ বছরে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার মধ্যে নারী কর্মী ২০ শতাংশ।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনালের একটি বন্ধ রয়েছে। এতে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে গেছে। ফলে দেশে সব ধরনের শিল্প-কারখানা, আবাসিক, বিদ্যুেকন্দ্র ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে তীব্র গ্যাসসংকট চলছে। টার্মিনালটি মেরামত শেষে চলতি মাসেই আবার চালু করা হবে বলেও জানা গেছে।

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য ও হামিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বিষয়টি নজরে আনেন। এ কে আজাদ বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে দাম বাড়ানো হলেও শিল্পে গ্যাসসংকট রয়েই গেছে। ডিজেল দিয়ে, সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস এনে কারখানার ব্রয়লার চালাতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ না থাকায় দেশে বিনিয়োগ আসছে না। প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে ক্যাপিট্যাল মেশিনারিজ আমদানি। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ।’

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত ২৭ মে থেকে একটি এলএনজি টার্মিনালের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। যার কারণে এলএনজির সরবরাহ প্রায় অর্ধেক কমেছে। মেরামতের কাজ শেষে চলতি মাসের মাঝামাঝি আবার চালু করা সম্ভব হবে। তখন গ্যাসসংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’

পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহের তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল শনিবার চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৫৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ওই দিন এক হাজার ৪১৯ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি ছিল। সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে দেশীয় কূপগুলো থেকে সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং একটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হয় ৫৭২ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি টার্মিনাল থেকে স্বাভাবিক সময়ে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে এক হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতো।