গ্যাস সংকটে কমছে উৎপাদন
আ.লীগ সরকারের দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে শিল্প খাত
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৯ AM , আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৯ AM
গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্পঘন এলাকায় বহু কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় এসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহে বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে শিল্প খাতের অর্থনীতি আরও বিপর্যয়ে পড়বে।
এই দুরবস্থা থেকে রক্ষা পেতে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়, এই চুরি বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি যানবাহন ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের গ্যাস রেশনিং করা যেতে পারে। রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
তারা জানান, গ্যাসের অভাবে তৈরি পোশাক খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ, স্টিল শিল্পে ২৫-৩০ শতাংশ ও সিরামিক শিল্পে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প খাতে চাহিদার অর্ধেকেরও কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ দরকার।
সেমিনারে জ্বালানি উপদেষ্টা সরকারি খাতে কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার অভাব ও আগে জ্বালানি কেনাকাটার জন্য মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের চিনতে হতো বলে মন্তব্য করেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা শিল্প খাতে গ্যাস সংযোগ নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির বড় স্তম্ভ ছিল জ্বালানি খাত। শিল্পের গ্যাস সংযোগ ছিল দাসখত। লুটপাটের বোঝা বইতে হচ্ছে শিল্পকে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও সম্মানিত হিসাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন গ্যাস সংযোগ পেতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
স্বাগত বক্তব্যে বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। উৎপাদনশীল খাতের অবস্থা আরও করুণ। শুধু সস্তা শ্রম আর গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে দেশে শিল্পায়ন হয়েছে। শিল্পায়নের বাকি অনুষঙ্গ জমি, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যাংক ঋণ, ঘুস-সবই এখন ব্যয়বহুল। এখন একদিকে গ্যাসের সংকট, অন্যদিকে দামও বেশি। তাই ব্যবসায়ীদের অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে। এ অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে শিল্পে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ বহালের বিকল্প নেই। অন্য খাতের সংস্কার সময় নিয়ে করা যায়। কিন্তু শিল্প বা ব্যবসার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা নিজেদের জন্য আত্মঘাতী হবে-যোগ করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাসের অভাবে তৈরি পোশাক খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ, স্টিল শিল্পে ২৫-৩০ শতাংশ ও সিরামিক শিল্পে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত পল্লী বিদ্যুতের অদক্ষতার কারণে ভুগছে। শিল্প খাতে চাহিদার অর্ধেকেরও কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আরও আশঙ্কার কথা হচ্ছে, গত দুই বছরে জ্বালানির ভোগ বাড়েনি। অর্থাৎ শিল্প খাত সংকুচিত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্পঘন এলাকায় গ্যাস সরবরাহে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়-মন্তব্য করে ইজাজ বলেন, গৃহস্থালির সরবরাহকৃত গ্যাসের অর্ধেকের বেশিই চুরি হয়। যানবাহনে গ্যাসের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। বর্তমান সরকার সিস্টেম লস বা চুরি বন্ধ করতে না পারলে পরবর্তী সরকার পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, জ্বালানি খাতের অবস্থা শীতকালের ছোট কম্বলের মতো। মাথা ঢাকতে গেলে পা বেরিয়ে যায়, পা ঢাকতে গেলে মাথা বেরিয়ে যায়। আসলে মূল সমস্যা হচ্ছে, সরকারি খাতে কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার অভাব ছিল। আগে জ্বালানি কেনাকাটার জন্য মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের চিনতে হতো। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুধু জ্বালানি তেল আমদানির শর্ত শিথিল করায় ছয় মাসে ৩৮০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে ক্রনি ক্যাপিটালিজম থেকে মুক্ত করতে কাজ করছে। এ ধরনের ব্যবসা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির বড় স্তম্ভ ছিল জ্বালানি খাত। লুটপাটের বোঝা বইতে হচ্ছে শিল্পকে। গ্যাসের প্রেসার কম থাকলেও মিটার বেশি ঘুরতে দেখেছি। শিল্পের গ্যাস সংযোগ ছিল দাসখত। এ প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ব্যবসায়ীদের নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, গ্যাস সংযোগ পেতে মন্ত্রীর বাসার সামনে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে, মনে হয়েছে চাকরি চাইতে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, গ্যাস কানেকশন পাওয়া ব্যাংক লাইসেন্স পাওয়ার মতো। তার ওপর অনেক লেকচার শুনতে হয়েছে। সর্বনিম্ন সম্মানটুকু পাইনি। তারপর নিজের কারখানায় গ্যাস নিতে নিজস্ব অর্থায়নে ৪৮ কিলোমিটার গ্যাসলাইন বসাতে হয়েছে। এজন্য রাস্তা কাটতে এবং স্থানীয় লোকজনকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এই চাঁদা দিতেও আবার ঘুসও দিতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এ ধরনের সংযোগের জন্য কোনো টাকা দিতে হবে না। শুধু নিজেরা নিজেদের জন্য বিনিয়োগ করেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, শিল্প খাত গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্য পরিশোধ করলেও আগে প্রতিনিয়ত ‘ওপর থেকে’ বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের চাপ দেওয়া হতো। সেই সংস্কৃতি থেকে পেট্রোবাংলা বেরিয়ে এসে শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে গ্যাস বণ্টন করছে। যার ফলে গত ১৭ অক্টোবরের পর থেকে শিল্প খাতে সর্বোচ্চ জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন শিল্পে গ্যাস সরবরাহ যে অবস্থায় আছে আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত তার চেয়ে অবস্থা খারাপ হবে না-নিশ্চয়তা দিতে পারি।
জনেন্দ্র নাথ বলেন, গ্যাস কূপ খননে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন দিলে ২০২৫-এ ৫০টি এবং ২০২৮ সালে একশটি কূপ খনন করতে পারব। আর মোট গ্যাসের ১০ শতাংশ অপচয় বা চুরির তথ্যের বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। বিতরণ কোম্পানিগুলোর ৫-৬ শতাংশ গ্যাস অপচয় হয়। এ অপচয় বন্ধে পেট্রোবাংলা কাজ করছে। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার মধ্যে ১১০টি শিল্প সংযোগ। আগামীতে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় অভিযান চালানো হবে।
ব্যবসায়ীরা যা বললেন : এমসিসিআই সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, দিনে ৫-৭ বার বিদ্যুৎ আসে-যায়। গ্যাসের চাপ সকালে থাকলে বিকালে থাকে না। শুধু জ্বালানি স্বল্পতার কারণে শিল্পের সক্ষমতা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সুনামকে কাজে লাগিয়ে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট হোক বা স্বল্প সুদে বিদেশি নিয়ে এলএনজি আমদানিতে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস চুরি বন্ধে দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণোদ্যমে চালু করতে হবে।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, গ্যাসের অভাবে নরসিংদী এলাকার অনেক শিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো শ্রমিকরা অন্য কারখানা চাকরির জন্য ভিড় করছে, ভাঙচুর চালাচ্ছে। শিল্প মালিকরা অসহায়। এত চাকরি দেবে কোত্থেকে। তিনি আরও বলেন, আমেরিকায় ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর চীন থেকে বিনিয়োগ সরতে শুরু করেছে। ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগের পরবর্তী গন্তব্য। জ্বালানি সংকট দূর করতে না পারলে এই বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব নয়।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির বলেন, জ্বালানি খাতে জবাবদিহিতার অভাবে শিল্প খাত ভুগছে। গ্যাস চুরির দায় ভালো ব্যবসায়ীদের বহন করতে হচ্ছে। এই চুরির সঙ্গে গ্যাস বিভাগের লোকও জড়িত। দায়িত্বশীলদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে গ্যাস চুরি বন্ধ হবে।
বিকেএমইএ’র সহসভাপতি শামসুজ্জামান বলেন, গত ১৫ বছর জ্বালানি খাতে লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গ্যাস চুরি হয়েছে। এমনো ঘটনাও ঘটেছে, যেই ম্যাজিস্ট্রেট চোরাই লাইন কেটেছে, সেই ম্যাজিস্ট্রেটই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার সেই লাইন লাগিয়ে দিয়েছে। শিল্পের স্বার্থে গ্যাস চুরি বন্ধের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ স্টিল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসাদুল আলম বলেন, গত সরকার দফায় দফায় দাম বাড়ালেও গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাইনি। এখন দেশের অর্থনীতির স্বার্থে শিল্পে যৌক্তিক মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।