নায়িকা নিপুণের উত্থান, জায়েদ খানকে হারাতে ১৭বার ফোন করেন শেখ সেলিম

নিপুণ
  © ফাইল ফটো

নিপুণ আক্তার। পেশায় চিত্রনায়িকা। তবে এই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিমের রক্ষিতা। বিষয়টি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলো ওপেন সিক্রেট। এমনকি সহকর্মীদের মধ্যেও চলতো রসালো গল্প। তবে মাথার ওপর শেখ পরিবারের সদস্য সেলিমের ছাতা থাকায় কেউ টু শব্দ করতে পারেননি। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিপুণ হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। অপরাগতা যেন তার ডিকশনারিতে ছিলই না। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, সরকারি দপ্তর থেকে শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়। সর্বত্রই ছিলো তার দৌড়।

নিপুণ এমপি বা মন্ত্রী নয়। শেখ হাসিনার সরকারের কোনো দায়িত্বেও ছিলেন না। তারপরও তার এই  প্রভাবের উৎস কী, নেপথ্যে কে? বিষয়টি অনেকেরই জানা। তবে মুখ খোলার দুঃসাহস দেখাননি কেউ। যদিও কখনও কখনও ক্ষীণভাবে উচ্চারিত হয়েছে আড়ালে থাকা একটি নাম। শেখ ফজলুর করিম সেলিম ওরফে শেখ সেলিম। শেখ হাসিনা সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। প্রধানমন্ত্রীর পরেই তার প্রভাব ছিলো বলে মনে করা হয়। জনসম্মুখে নিপুণ শেখ সেলিমকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করলেও তাদের একান্ত ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে জানতো অনেকেই। শেখ সেলিমের ভালোবাসায়-আর্শীবাদে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন নিপুণ। সরকারি বেশ কয়েক দপ্তরে ছিল নিপুণের রাজত্ব। এরমধ্যে অন্যতম রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউক থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিপুণ।

এদিকে এ চিত্রনায়িকা চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন, এমন অভিযোগ আগেই উঠেছিল। বিশেষ করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে ২০২২ সালে কম জল ঘোলা হয়নি। সেবার নির্বাচনে সভাপতি পদে ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রাথমিক ভোট গণনায় জায়েদ খান জয়ী হন। কিন্তু এই ফলাফল মেনে নেননি সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজিত প্রার্থী নিপুণ আক্তার।

পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশে শিল্পী সমিতির চেয়ারে বসেন তিনি। জানা যায়, শিল্পী সমিতিতে নিপুণের দাপটের পেছনে এক রাজনীতিবিদের সরাসরি প্রভাব ছিল। সে সময় ভয়ে মুখ না খুললেও এবার প্রকাশ্যেই শিল্পী সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনলেন সে সময় দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনাররা।

সূত্র জানায়, নির্বাচনের ফলাফলের রাতটি ছিল নির্বাচন কমিশনারদের জন্য ভয়াবহ পরীক্ষার রাত। ফলাফল গণনার শুরু থেকেই একের পর এক হুমকি আসতে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক হয় ফলাফল ঘোষণার আগমুহূর্তে। কারণ, জায়েদ খানের চেয়ে ভোটে পিছিয়ে যান নিপুণ। তখন থেকেই একের পর এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ভয়ভীতি দেখান।

ওই ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা পিরজাদা হারুন জানান, তিনি পাঁচবার শিল্পী সমিতির নির্বাচনে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের নির্বাচনে তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়, যা তাঁকে মানসিকভাবে এখনো আতঙ্কিত করে।

হারুন বলেন, ‘নির্বাচনে নিপুণকে জয়ী দেখাতে অনেক ওপর থেকে এক ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ একের পর এক ফোন করতে থাকেন। তিনি সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়ে সরাসরি প্রভাব খাটাতেন, নিয়ন্ত্রণ করতেন বলা যায়। তিনি নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি সরাসরি “না” বলে দিই। এর আগে আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালীন একবার উপজেলা নির্বাচনে ওই নেতার শ্যালকের জন্য আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন যে আমাকে কেনা যাবে না। এ জন্য আমি বারবার সরকারি চাকরিতে পদবঞ্চিত হয়েছি।’

পরবর্তী সময় মুঠোফোনে ভয়ও দেখানো হয়, এমনকি বড় অঙ্কের অর্থের লোভ দেখানো হয় উল্লেখ করে হারুন বলেন, ‘তখন একের পর এক ফোনে আমাকে ভয় দেখানো হয় যে তুলে নিয়ে যাবে। এখন যে আয়নাঘরের কথা শুনছি, তখন সে রকম কোনো আয়নাঘরের কথা শোনা থাকলে হয়তো সৎ থাকা সম্ভব হতো না। সেই রকম ভয় দেখানো হয়েছিল। পরে একটা জায়গায় যেতে বলেন, যেখানে বড় অঙ্কের টাকা রাখা ছিল। যখন রাজি হলাম না, তখন ফলাফল নিয়ে মামলা করা হলো। সেটা চলে গেল কোর্টে। তখন নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আমাকে বানিয়ে দেওয়া হলো অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। নানা কাণ্ডে আমাকে ছোট করা হলো, এফডিসিতে নিষিদ্ধ করা হলো।’

সে বছর ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২২-২৪ মেয়াদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে চিত্রনায়ক জায়েদ খানের কাছে ১৩ ভোটে পরাজিত হন চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার। ফলাফলে অসন্তোষ জানিয়ে ভোট পুনর্গণনার জন্য আপিল করেন নিপুণ। কিন্তু সেখানেও একই ফলাফল পায় আপিল কমিটি।

শিল্পী সমিতির সেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত আরেকজন জানান, এমন আতঙ্ক হবে ভাবলে তিনি দায়িত্ব পালন করতেন না। কারণ, জীবনের হুমকি ছিল। যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল। সেগুলো ভয়ে তখন প্রকাশ করেননি। তাঁরা বিষয়গুলো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপরই ছেড়ে দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের একের পর এক ভয়ভীতি দেখিয়ে গালিগালাজ করা হয়। বলা হয় যে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। এমন লেভেল থেকে ফোন আসবে, ভাবতেই পারিনি। আমাদের একজনকে সেই সময় নিপুণকে জয়ী করাতে ১৭ বার ফোন করেন শেখ সেলিম সাহেব, তাঁর মতো লোক। এটা আমাদের অবাক করেছিল।’ পরে ঘটনা মামলায় গড়ায়। আদালত থেকে রায় নিয়ে শিল্পী সমিতির চেয়ারে বসে নিপুণ। তিনি পুরো সময় দায়িত্ব পালন করেন।

জানা যায়, নিপুণ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য রাজউকের উচ্চমান সহকারী মাহবুব হোসেন। সিবিএ নেতা। মাহবুবের বাড়ি গোপালগঞ্জে। শেখ সেলিমের লোক হিসেবে পরিচিত তিনি। এই মাহবুুবের সঙ্গে নিপুণকে পরিচয় করিয়ে দেন শেখ সেলিম। ২০১৪ সালের পর থেকেই রাজউকে আধিপত্য বিস্তার করেন নিপুণ। ড্রয়িং এপ্রুভাল, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট, রাজউকের নামজারিসহ এই দপ্তরে অন্যান্য কাজ করাতেন নিপুণ। লোক মারফতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতেন তিনি। মাহবুবের কাছে অফিসাররা ছিলেন জিম্মি। মাহবুবের কাজে টাকা চাইতেন না তারা। ‘শেখ সেলিমের লোক’ এই পরিচয়ে মাহবুব অত্যন্ত প্রভাবশালী। যে কারণে মাহবুবের কাজ হতো দ্রুত গতিতে। অনেক সময় ‘ক্লায়েন্টকে’ মাহবুবের কাছে পাঠাতেন নিপুণ। তখন রাজউক ভবনের পাশের বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে নিয়ে যেতেন ক্লায়েন্টকে। সেখানে গিয়ে নিপুণের কথামতো ক্যাশ টাকা নিতেন মাহবুব। ওই কক্ষেই টাকা রাখা হতো। অফিস শেষে সেই টাকা পাঠানো হতো নিপুণের বাসায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিপুণের সঙ্গে শেখ সেলিমের সম্পর্কের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত না করার জন্যই সরাসরি সেখানে যেতেন না নিপুণ। এ কাজে ব্যবহার করা হতো মাহবুবকে।

জানা গেছে, ড্রয়িং এপ্রুভালের ক্ষেত্রে ৮ তলা ভবনের জন্য ২০-২৫ লাখ, ১০ তলার জন্য ৫০ লাখ টাকা নিতেন নিপুণ। তবে মাঝেমধ্যে ২-৩ লাখ টাকা ভাগে পেতেন মাহবুব। শেখ সেলিম যখন যেখানে ডাকতেন তার সেবায় উপস্থিত হতেন নিপুণ। নিপুণের ‘সেবা প্রদানকারী’ টিমে রয়েছে একঝাঁক সুন্দরী। তারা কেউ মডেল, কেউ নায়িকা, কেউ শিক্ষার্থী। নিজে যেমন শেখ সেলিমের জন্য নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি এই সুন্দরী টিমের সদস্যদের নিয়োজিত রাখতেন নিপুণ।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে নিপুণ গড়ে তোলেন প্রসাধনী ও লাইফ-স্টাইল কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’। সাধারণত শেখ সেলিমের মতো নেতা পার্লার উদ্বোধন করার কথা না হলেও নিপুণের এই পার্লারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন তিনি। এই পার্লারকে কেন্দ্র করে বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় নিপুণ গড়ে তুলেছেন অনৈতিক বাণিজ্যের বৈধ হাট। তার পার্লারে কর্মরত কোনো মেয়ে অনৈতিক কাজ করতে আপত্তি জানালে তাকে মামলার ভয় দেখাতেন নিপুণ। ডেকে আনতেন পুলিশ। রেগে গিয়ে মারধরও করতেন তিনি।

কথিত রয়েছে, এই পার্লারটি তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন শেখ সেলিম। এমনকি নিপুণের প্রতি দুর্বলতা এতোটাই ছিল যে, নিপুণের সঙ্গে শেখ সেলিম সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এমনটি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন নিপুণ নিজেই। শেখ সেলিম ও নিপুণের ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ ছিল ওপেন সিক্রেট। এই বার্তা পৌঁছে যায় শেখ সেলিমের পরিবারের সদস্যদের কাছেও। যে কারণে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি আর করা হয়নি। তবে সিনেমা না করলেও এফডিসিতে নিপুণকে বিশাল প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিয়েছিলেন শেখ সেলিম।

আর এ কারণেই হেরেও হারেন না নিপুণ। ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারির বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে চিত্রনায়ক জায়েদ খানের কাছে সাধারণ সম্পাদক পদে হেরে যান নিপুণ। তারপর প্রভাব খাটিয়ে নানা খেলা দেখান তিনি। পরবর্তীতে বিজয়ী প্রার্থী জায়েদ খানকে অযোগ্য ঘোষণা করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির আপিল বোর্ড। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান নিপুণ আক্তার। কোনো নিয়ম কানুনের বালাই নেই। শেখ সেলিমের নির্দেশে এমনটি হয়েছিলো বলেই জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। পরবর্তীতে জায়েদ খানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২ মার্চ হাইকোর্ট জায়েদ খানকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখল করে রাখেন নিপুণ। জায়েদ ও নিপুণ দু’জনই আওয়ামী লীগের আর্শীবাদপুষ্ট হলেও নিপুণের প্রভাবে পেরে ওঠেননি জায়েদ। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জায়েদ খানকে কোণঠাসা করেছিলেন এই নায়িকা।

নায়িকা নিপুণ আক্তারের পুরো নাম নাসরিন আক্তার নিপুণ। ২০০৬ সালে চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় তার। তার প্রথম চলচ্চিত্র এফ আই মানিক পরিচালিত পিতার আসন। নিপুণের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুরা উপজেলার জালগাঁও। তার পিতা মনসুর আলী। ১৯৯৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের পর রাশিয়া চলে যান তিনি। মস্কো থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০১ সালে সেখানে নিপুণ বিয়ে করেন কুমিল্লা শ্মশানগাছার সন্তান মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন অপু নামে এক ব্যবসায়ীকে। অপুর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একমাত্র সন্তান তানিসা হোসেনকে নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করতেন। কিন্তু নিপুণের বাধার কারণে কোনোভাবেই মেয়ে তানিসা হোসেনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান না অপু। কথাও বলতে পারেন না। এ বিষয়ে সাজ্জাদ হোসেন অপু জানান, নিপুণ সবসময় শেখ সেলিমের ভয় দেখাতেন। যখনই মেয়ের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন, তখনই প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অপু বলেন, নিপুণ মূলত শেখ সেলিমের রক্ষিতা। এসব কারণে ২০০৩ সালে নিপুণ আমাকে ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তীতে আমি তাকে ডিভোর্স দেই। নিপুণ তার কাছ থেকে ১০০ ভরি স্বর্ণসহ বিপুল ডলার নিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।

এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বারবার চেষ্টা করেও নিপুণ আক্তারকে পাওয়া যায়নি। একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্টে অবস্থান করছেন এই নায়িকা।