জর্জ বুশ সিআইএ-কে ইয়াসির আরাফাতের বিকল্প খোজার নির্দেশ দিয়েছিল, ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্য

ইয়াসির আরাফাত
পিএলও-এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত   © সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জজ ডব্লিউ বুশ দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাতের বিকল্প খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল আরাফাতের উত্তরসূরি খোঁজার ব্যাপারে বুশের সঙ্গে একমত ছিলেন না। ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্যের আলোকে এ খবর প্রকাশ করেছে আল–জাজিরা।

খবরে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি নেতা এহুদ বারাকের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নেয় যে আরাফাতের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।

যুক্তরাজ্যের নথি অনুসারে, ২০০১ সালে বুশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পবিত্র আল আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনে ব্যাপক উত্তেজনা চলছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশমতো উত্তেজনা থামাতে পারছিলেন না ইয়াসির আরাফাত।

এ কারণে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে ইয়াসির আরাফাতের বিকল্প খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ। কিন্তু সিআইএ ফিলিস্তিন পরিস্থিতির ওপর ব্যাপক গবেষণা করে জানিয়েছিল, ‘ইয়াসির আরাফাতের কোনো উত্তরসূরি তারা খুঁজে পায়নি।’

২০০০ সালে ইয়াসির আরাফাত ও এহুদ বারাকের আলোচনা স্থগিত হওয়ার পর ডব্লিউ বুশ এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়েছিল। টেলিফোনে দুই নেতা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। আলোচনার একপর্যায়ে টনি ব্লেয়ার বলেন, ইয়াসির আরাফাত এ জন্য দায়ী। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি নেতা কেবল তাঁর অবস্থান বজায় রাখার জন্য কাজ করছেন। আরাফাতের আর কিছু দেওয়ার নেই। তাঁরা সম্ভাব্য সব ছাড় দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

টনি ব্লেয়ারের এ বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন ডব্লিউ বুশ। তারপর ইয়াসির আরাফাতকে ‘দুর্বল ও ব্যর্থ’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, সিআইএকে ফিলিস্তিনের নেতার সম্ভাব্য উত্তরসূরি খুঁজতে বলেছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাটি বলেছে, ‘ফিলিস্তিনিদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে আরাফাতের কোনো উত্তরসূরি পাওয়া যাচ্ছে না।’

ব্রিটিশ এই নথিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল আরাফাতের উত্তরসূরি খোঁজার ব্যাপারে বুশের সঙ্গে একমত ছিলেন না।

ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাত আজীবন একটা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন লালন করেছেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে। নির্বাসিত জীবনের গ্লানি সহ্য করেছেন, এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্য দেশে।

কখনো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, আবার কখনো আলোচনার টেবিলে বসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছেন বারবার। জীবনের শেষ দিনগুলোয় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখে। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে পোলোনিয়াম বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষ তাঁর শরীর ও পোশাকে পাওয়া গিয়েছিল। এ ঘটনার জন্য ফিলিস্তিন ও আরবরা ইসরায়েলকে দায়ী করে। তবে ইসরায়েল অভিযোগ অস্বীকার করে।

ইয়াসির আরাফাতের জন্ম ১৯২৯ সালে মিসরের কায়রোতে। কায়রোর ইউনিভার্সিটি অব কিং ফুয়াদ ওয়ানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করলে তিনি অন্য ছাত্রদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে কায়রো ফিরে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ফিরে যান ইয়াসির।

১৯৫০ সালে স্নাতক সম্পন্ন হলে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যোগ দেন রাজনীতিতে। ১৯৫৯ সালে কুয়েতে নির্বাসিতকালে ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুক্তির সংগঠন ‘ফাতাহ’ গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের নাম হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৭-৬৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সম্মুখসারিতে থেকে যুদ্ধ করেন ইয়াসির আরাফাত।

১৯৬৯ সালে ইয়াসির আরাফাত নির্বাচিত হন পিএলওর চেয়ারম্যান হিসেবে। এ সময় তিনি জর্ডানে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। ১৯৭০ সালে জর্ডান থেকে চলে যান লেবাননে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গড়ে তোলেন পিএলওর সদর দপ্তর। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করলে পিএলওর সদর দপ্তর তিউনিসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।

১৯৯৪ সালে আরাফাত অসলো শান্তি চুক্তির জন্য আইজাক রবিন ও শিমন পেরেজের সাথে একত্রে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু একই সময়ে হামাস ও অন্যান্য সংগঠনের উত্থান ঘটে, যারা ফাতাহ ও আরাফাতের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল করে দিয়ে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়।

২০০২ থেকে ২০০৪ সালের শেষভাগ পর্যন্ত আরাফাত ইসরাইলী সেনাবাহিনীর হাতে তার রামাল্লার দপ্তরে কার্যত গৃহবন্দী হয়ে থাকেন। ২০০৪ এর শেষদিকে আরাফাত অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং কোমায় চলে যান। আরাফাতের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ পায়নি; কিন্তু চিকিৎসকদের মতে ,তিনি ইডিওপ্যাথিক থ্রম্বোসাইটোপেনিক পারপুরা এবং সিরোসিসে ভুগছিলেন। তিনি ২০০৪ সালের নভেম্বর ১১ তারিখে প্যারিসে চিকিৎসারত অবস্থায় ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে বলে সুইস গবেষকরা দাবি করেন। সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা বলছেন তারা ইয়াসির আরাফাতের দেহাবশেষ-এর গবেষণার পর তার হাড়ে বিষাক্ত পোলোনিয়ামের সন্ধান পেয়েছেন।

সুত্র: আল জাজিরা


মন্তব্য