সৌদি-ইরান সম্পর্ক: মার্কিন ও ইসরাইলি গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গী কী?
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ০৪:৫৭ PM , আপডেট: ২০ জুন ২০২৩, ০৪:৫৭ PM

সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান সম্প্রতি তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসির সাথে সাক্ষাতে বলেছেন, কোনো কোনো দেশ চায় না আমাদের অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক।
তিনি বলেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য সীমাহীন সাফল্য বয়ে আনবে এবং বাইরের কোনো দেশই এ অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে না।
এছাড়া, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ানের সাথেও সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাক্ষাত করেন। এ সাক্ষাতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা একটি অধিকতর নিরাপদ ও সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা সকলের জন্য একটি মৌলিক ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয় এবং একটি নিরাপদ, আরও সমৃদ্ধ ও আরও উন্নত ভবিষ্যতে পৌঁছার জন্য একটি অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তা।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, তার দেশ নিরাপত্তা বলতে কখনোই সামরিকীকরণকে বোঝায় না বরং আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বিস্তৃতির মাধ্যমে সকল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
আব্দুল্লাহিয়ানের সাথে সাক্ষাতের পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার ইতিবাচক ও স্বচ্ছ আলোচনা হয়েছে। অচিরেই তেহরানে সৌদি দূতাবাস আবার চালু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে ইরান-সৌদি সম্পর্ক এগিয়ে যাবে।
বেইজিংএ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সমঝোতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমেরিকা ও ইসরাইল এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তারপরও তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে এবং দিন দিন এ সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে। তবে আমেরিকা কিছুটা সুর নরম করায় ইরান-সৌদি সুসম্পর্কের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে এখন ইসরাইল কার্যত একা হয়ে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সংবাদ ও রাজনৈতিক মহল সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরান সফরকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এটাকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। কিন্তু ইসরাইলি কর্মকর্তারা সাথে সাথে এ ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না দেখালেও এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারেনি।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরান সফরের পর ইসরাইলের গণমাধ্যমগুলো তেহরান-রিয়াদ ঘনিষ্ঠতাকে রিয়াদ-তেলআবিব সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পথে বড় বাধা হিসেবে বর্ণনা করেছে। গণমাধ্যমগুলো মন্তব্য করেছে এতে ইসরাইল ও সৌদি আরবের দূরত্ব বাড়বে যা কিনা ইসরাইলের স্বার্থের পরিপন্থী। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব অঙ্গনে ইরানকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরান ও সৌদি কর্মকর্তারা যখনই কোনো সাক্ষাতে মিলিত হন কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেন তখনই ইসরাইলি কর্মকর্তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। কারণ ইসরাইলের রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি আমেরিকার সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নানা ইস্যুতে মতবিরোধ থাকলেও ইরানের ব্যাপারে তারা সব একজোট। বিশ্বে ইরান আতঙ্ক সৃষ্টি, আরব দেশগুলোর সাথে ইরানের দূরত্ব সৃষ্টি করা এবং আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা সব ঐক্যবদ্ধ এবং সেভাবে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাতই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ইসরাইল ও আমেরিকার কর্মকর্তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে।
মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা ইরানকে তাদের জন্য অনেক বড় হুমকি বলে মনে করে। অন্যদিকে সৌদি আরবকে তাদের শক্তিশালী অংশীদার ও মিত্র হিসেবে দেখে। তাই তারা ভেবেছিল অচিরেই রিয়াদের সাথে তেলআবিবের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
এ কারণে তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ইসরাইলি কর্মকর্তারা বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েন এবং তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এ ঘটনায় নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরাইলি মন্ত্রীসভায়ও তীব্র মতবিরোধ ও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে নেতানিয়াহু বহুদিন ধরে ইরান বিরোধী লড়াইয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন এবং তিনি আশা করছেন ইসরাইলের পক্ষে সৌদি আরবের জোরালো সমর্থন আদায়ে সক্ষম হবেন। কিন্তু তেহরান-রিয়াদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে তিনি হতাশ হয়েছেন। কেননা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ঘটনা ইরানের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের সব মুসলিম দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসরাইলের অনুকূলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বলয় তৈরির যে বিরাট লক্ষ্য নিয়ে ইসরাইল এগিয়েছিল তা মাটির সাথে মিশে গেল।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম দ্য জেরুজালেম পোস্ট এক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। সেখানে সৌদি-ইরান সম্পর্ককে ইরানের গেম প্লান হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া এটা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়িসি সম্প্রতি বেইজিং সফরে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করেন। ওই সফরের পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি তেহরান-বেইজিং সমঝোতা বাস্তবায়নের অবস্থা খতিয়ে দেখতে চীন সফরে যান এবং সেইসাথে তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে চীনা কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন।
এরপর চলতি বছর ১০ মার্চ রাজধানী বেইজিংএ ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পররাষ্ট্র বিষয়ক দফতরের প্রধান ওয়াং ই এবং সৌদি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মোসায়েদ বিন মোহাম্মদ আল-আইবানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বিবৃতি প্রকাশিত হয় যা তেহরান-রিয়াদ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ খুলে দেয়।
বর্তমানে তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই এ দুই দেশ সম্পর্ক আরো গাঢ়হ করার জন্য কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুই মুসলিম রাষ্ট্র ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার এ সম্পর্ক নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। রিয়াদ ও জেদ্দায় ইরানের দূতাবাস ও কনস্যুলেট খোলার পর, ঈদুল আজহার পর তেহরান ও মাশহাদেও সৌদি দূতাবাস ও কনস্যুলেট পুনরায় চালু করা হবে।
সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এরই মধ্যে রিয়াদ সফরের জন্য ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ সফর অনুষ্ঠিত হলে এবং একই সাথে ইরানের আমন্ত্রণে সৌদি রাজা ও যুবরাজও যদি ইরান সফরে আসেন তাহলে নিঃসন্দেহ তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে।