গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ, ফিলিস্তিনি-বিরোধী মিথ্যাচার ও সম্ভাব্য স্থল-হামলা

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার এক শিশু  © পার্স টুডে

যুদ্ধের ময়দানে বড় ধরনের পরাজয় আর বিপর্যয়ের দুর্বলতা ও কলঙ্ক ঢাকতে ইহুদিবাদী ইসরাইল অবরুদ্ধ গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ জোরদার করেছে।

গাজায় নিহত বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ১৫৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের প্রায় ষাট শতাংশই নারী ও শিশু।

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা (সংগৃহীত)  

কিন্তু দখলদার ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী বিশ্বের কাছে এটা প্রচার করছে যে তারা বেসামরিক জনগণের ওপর নয় বরং হামাসের সেনাদের টার্গেট করেই গাজায় হামলা চালাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হল ইসরাইল আসলে গোটা ফিলিস্তিনি জাতির সঙ্গে নৃশংসতা ও পৈশাচিকতা অব্যাহত রেখেছে এবং গাজায় অব্যাহত গণহত্যা অভিযানই তার প্রমাণ। 

শুধু তাই নয় গাজায় জাতিগত শুদ্ধি অভিযান জোরদার করতেই ইসরাইল সেখানে পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এরই অজুহাত হিসেবে ইসরাইলি যুদ্ধমন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ত ফিলিস্তিনি সংগ্রামী বা মুজাহিদদেরকে পশু বলে উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে এরই আলোকে আচরণ করার কথা বলেছেন।

আরও পড়ুন:- গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে ঘরবাড়ি ছাড়ার নির্দেশ ইসরাইলের

এ ছাড়াও ইসলামী জিহাদ ও হামাসকে সন্ত্রাসী বা মানবতা-বিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা সহযোগী সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা কোনো কোনো মিডিয়া নানা মিথ্যা খবর বা অপবাদ প্রচার করছে। যেমন, সম্প্রতি ইসরাইলের পক্ষ থেকে কোনো কোনো বানোয়াট ছবি প্রকাশ করে প্রচার করা হয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা বা হামাসের সেনারা ইসরাইলি শিশুদের শিরশ্ছেদ করেছে।  ছাড়াও এইসব মহল থেকে দাবি করা হয়েছে যে সংগ্রামী ফিলিস্তিনিরা বহু ইসরাইলি নারীকে ধর্ষণ করেছে!

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার এক ফিলিস্তিনি শিশু (সংগৃহীত)

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এইসব তথ্যের আলোকে হামাসকে দায়েশ বা আইএস-এর চেয়েও বড় রক্ত-পিপাসু বা সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ পরে হোয়াইট হাউজই স্বীকার করেছে যে বাইডেন বা হোয়াইট হাউজের কেউই এ ধরনের ছবি দেখেননি এবং এইসব সংবাদকে স্বীকৃতিও দেননি!

নারী ও শিশুসহ বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিকতার বিরোধী এবং যুদ্ধ-অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমগুলো তা তুলে ধরছে না। 

পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে উল্লেখ করলেও দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সন্ত্রাসী হামলা বা হিংস্র আচরণ হিসেবে তুলে ধরছে।

নিজ ভূমে পরবাসী করে রাখা ফিলিস্তিনিরা যে ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতার জবাবে মজলুম হিসেবেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় পাল্টা হামলা হিসেবে সাম্প্রতিক অভিযানগুলো চালিয়েছে সে বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করছে পশ্চিমা সরকারগুলো ও তাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ-মাধ্যম।

আরও পড়ুন:- ফিলিস্তিনে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস ব্যবহার করছে ইসরায়েল, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে গাজা-লেবাননের মানুষ

ফিলিস্তিনিরা গত সাত দশক ধরে প্রায়ই ইসরাইলি নৃশংস হামলায় নিহত হলেও কখনও সেসবকে হত্যাযজ্ঞ হিসেবে তুলে ধরেনি পশ্চিমা মিডিয়া। অথচ ফিলিস্তিনি সংগ্রামীদের হাতে নিহত দখলদার সেনা ও সন্ত্রাসী ইসরাইলিদের প্রাণহানিকে খুব নৃশংস ঘটনা বা হত্যাযজ্ঞ বলে প্রচার করছে।

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত গাজা (সংগৃহীত)

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলোর মধ্যে ইরান, ইরাক ও ইয়েমেনসহ খুব অল্প বা গুটি-কতেক সরকার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া নিন্দা বা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আরব লীগও ইসরাইলী অপরাধযজ্ঞ থামাতে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আরব লিগ আর ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি নিষ্ক্রিয় ও মেরুদণ্ডহীন সংস্থার মতই আচরণ করছে। অথচ মুসলিম সরকারগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরাইল ও তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বহু আগেই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা ও মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসাকে মুক্ত করা সম্ভব হত। 

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী বলেছিলেন, মুসলমানরা বা আরবরা এক বালতি করে পানি ঢাললেও ইসরাইল ভেসে যেতো। 

এদিকে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সামরিক সহযোগিতা ও অস্ত্র চালান পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। এরই আলোকে ইসরাইল সম্ভবত গাজায় স্থল-অভিযান চালানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইসরায়েলি নৃশংসতার শিকার কিছু ফিলিস্তিনি শহীদের মৃতদেহ (সংগৃহীত)

কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীত ও বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলা ও গেরিলা বা কমান্ডো অভিযানগুলো ঠেকাতে চরম ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ইসরাইল গাজায় স্থল হামলা চালাতে গেলে আরও ব্যাপক পরাজয় বা বিপর্যয়ের শিকার হবে।-খবর পার্স টুডের।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ বলেছে, হামাসের আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলি বোমা হামলার পর গাজা উপত্যকায় ৪ লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দিনের শেষ পর্যন্ত গাজায় বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা ৮৪,৪৪৪ জন বেড়ে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৭৮ জনে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন:- ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনে ৫০০ শিশুসহ নিহত ১৫৩৭

হামাসের শনিবারের হামলার জবাবে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক হামলা চালানোর ঘোষণা দেয়। হামাস যোদ্ধাদের হামলায় ১৩০০ ইসরাইলি মারা যায় এবং প্রায় ১৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসে।

ইসরায়েলি হামালায় গাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরিয়ে আসছে মা ও শিশু (সংগৃহীত)

হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল ২৩ লাখ লোকের একটি ঘনবসতিপূর্ণ ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় নির্বিচারে বিমান ও কামানের গোলা হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এতে ভবনগুলো মাটির সাথে মিশে গেছে। এই নির্বিচার হামলা চালিয়ে ইসরাইল ১,৫৩৭ জন ফিলিস্তিনিকে লোককে হত্যা করেছে। এদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক এবং নারী ও শিশু।

ইসরাইল ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে স্থল অভিযান শুরু করেছে। ওসিএইচএ বলেছে, ‘আকাশ, সমুদ্র এবং স্থল থেকে ভারী ইসরাইলি বোমাবর্ষণ প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে। ওসিএইচএ জানায়, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একাধিক আবাসিক ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।’

এতে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুতদের দুই-তৃতীয়াংশ ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সমর্থনকারী জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত স্কুলে আশ্রয় চেয়েছে।

ইসরায়েলি হামলায় নিহত স্বজনের লাশ কোলে নিয়ে কাঁদছে এক মা (সংগৃহীত)

আরও প্রায় ২৭ হাজার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পরিচালিত স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। ওসিএইচএ জানিয়েছে, শনিবারের হামলার আগে প্রায় ৩,০০০ মানুষ ছিটমহলের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ওসিএইচএ গাজার গণপূর্ত ও আবাসন মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা উদ্ধৃত করে বলেছে, বোমা হামলার অভিযানে ৭৫২টি আবাসিক এবং অনাবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। যার মধ্যে ২,৮৩৫টি আবাসন ইউনিট রয়েছে। আরও প্রায় ১,৮০০টি আবাসন ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

জাতিসংঘের সংস্থাটি ইসরাইল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ধ্বংসের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।