০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:৪০

জাপানে বিমানে আগুন লাগার পর মাত্র দেড় মিনিটে ৩৭৯ যাত্রীর সবাইকে জীবিত উদ্ধার

  © সংগৃহীত

জাপানের টোকিওতে হানেদা বিমানবন্দরের রানওয়েতে দুটি বিমানের সংঘর্ষে পাঁচ জন মারা গেছেন এবং শতাধিক যাত্রী রক্ষা পেয়েছেন।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অবতরণের সময় রানওয়েতে পার্ক করে রাখা আরেকটি বিমানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে দুটি বিমানেই আগুন ধরে যায়।

আগুন ধরা অবস্থাতেই জাপান এয়ারলাইন্সের বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করে। মুহূর্তেই পুরো রানওয়ে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়।

জাপান এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩৫০ উড়োজাহাজে সে সময় ৩৭৯ জন আরোহী ছিলেন, যাদের মধ্যে আটজন ছিল শিশু। তবে তাদের সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। মাত্র ৯০ সেকেন্ড বা দেড় মিনিটে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হওয়া হয়। 

প্রায় বিদ্যুতের গতিতে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিকে অলৌকিক দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ওই উড়োজাহাজের জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কতটা কার্যকর, তা-ও এই ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে।     

কোস্টগার্ডের উড়োজাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ওই ঘটনা ঘটে। উড়োজাহাজটিতে গত সোমবারের তীব্র ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে খাবার নিয়ে যাচ্ছিল কোস্টগার্ড।

যাত্রীবাহী ও কোস্টগার্ড উড়োজাহাজের সংঘর্ষে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে ৩৭৯ আরোহীর সবাই বেঁচে ফিরলেও পাঁচ কোস্টগার্ডের মৃত্যু হয়। 

বিশেষজ্ঞদের বরাতে সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম সিএনএ বলছে, ওই ফ্লাইটের যাত্রীরা জরুরি প্রটোকল অনুসরণ করেছেন। তাঁরা জিনিসপত্র সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। উড়োজাহাজটির ইমার্জেন্সি এক্সিট বা জরুরি বহির্গমনের স্লাইডগুলো একযোগে ব্যবহার করা হলেও কোনো সমস্যা হয়নি। 

যাত্রীবাহী উড়োজাহাজটির ৩৬৭ যাত্রী ও ১২ জন ক্রুর সবাই কোনো গুরুতর আঘাত ছাড়াই মাত্র ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে বের হয়ে যেতে পেরেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবিনে ধোঁয়ার পরিমাণ কম হওয়ায় যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট বা শ্বাসরোধ হয়নি এবং তাঁরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। 

এয়ারলাইনসের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনুমতি নিয়েই উড়োজাহাজটি নিয়ে অবতরণ করেন ক্যাপ্টেন। তবে আকারে ছোট সামুদ্রিক টহল বিমানটি নজর এড়িয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই রানওয়েতে দুটি উড়োজাহাজ কীভাবে এল, তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত। পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

আজ বুধবার সিএনএকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারী অধ্যাপক শন প্রুচনিকি বলেন, উড়োজাহাজটির যাত্রী সরিয়ে নেওয়ার গতি ছিল এককথায় দুর্দান্ত। 

তিনি বলেন, যাত্রীরা আসলেই ৯০ সেকেন্ডের মধ্য বের হওয়ার অর্থ তাঁরা কেউ লাগেজ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। উড়োজাহাজ জরুরিভিত্তিতে খালি করার সময় জিনিসপত্রসহ যাত্রীদের নামার চেষ্টা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।

আয়ারল্যান্ডের অ্যাভিয়েশন এবং এয়ার ট্রান্সপোর্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান পেগাসাস অ্যাভিয়েশন অ্যাডভাইজর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেসমন্ড রস বলেন, জরুরি প্রয়োজনে ৯০ সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে উড়োজাহাজ খালি করার সক্ষমতা প্রমাণে বৈশ্বিক সংস্থার কাছ থেকে সনদ নিতে হয়। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ৩৮০ ও সব ধরনের উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। 

ডেসমন্ড রস সিএনএকে বলেন, ওই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা দরজা খোলার ক্ষেত্রে ও যাত্রীদের দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কাজে দুর্দান্ত দক্ষতা দেখিয়েছেন। তবে স্লাইডে দৌড়ে নামবে নাকি পিছলে নামবে সে বিষয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন যাত্রীরা।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু, তাঁরা যে বড় আঘাত ছাড়াই নিচে নামতে পারলেন—তা সত্যিই অসাধারণ।’

এয়ারলাইনসের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক ওয়েবসাইট এয়ারলাইনরেটিংস ডটকমের প্রধান সম্পাদক জফ্রি থমাস বলেন, উড়োজাহাজটির নিরাপত্তাব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি যে যাত্রীরা অর্ধেক জরুরি স্লাইড ব্যবহার করেই ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে বের হয়ে যেতে পারে। 

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার ক্ষেত্রে আমি শুধু তিনটি স্লাইড ব্যবহার করতে দেখেছি। উড়োজাহাজটির দুই পাশেই ৫টি করে ১০টি স্লাইড আছে। তাই এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা এবং অলৌকিকও বটে।’

এ ছাড়া উড়োজাহাজ তৈরিতে আধুনিক সামগ্রীর ব্যবহারও যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছে বলে উল্লেখ করেন ডেসমন্ড রস। আগেকার্র উড়োজাহাজে দাহ্য পদার্থ বেশি ব্যবহার করা হতো। এমনকি সিটগুলোতেও সহজেই আগুন ধরে যেত। 

হানেদা বিমানবন্দরের দুর্ঘটনার ছবি থেকে দেখা যায়, জাপান এয়ারলাইনস উড়োজাহাজটি দাউ দাউ করে জ্বললেও বেশ কিছু অংশ এখনো অক্ষত আছে। 

রস বলেন, ‘অনেক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাত্রীরা বেঁচে ফিরলেও ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে এবং উড়োজাহাজের অন্যান্য বস্তু পোড়ার পরবর্তী প্রভাবে মারা যায়। তাই বিষাক্ত ধোঁয়া সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো উপাদান অপসারণের জন্য কয়েক বছর ধরে অনেক কাজ করা হয়েছে।’

সহকারী অধ্যাপক শন প্রুচনিকি আরও বলেন, ‘কেবিনে তুলনামূলক কম ধোঁয়া প্রবেশ করায় যাত্রীরা সহজে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন। অন্যান্য দুর্ঘটনায় আমরা দেখেছি, এমন তীব্র ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় যে মেঝে পর্যন্ত দেখা যায় না। কেউ ঠিকঠাক বুঝেও উঠতে পারে না আর ধোঁয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’ 

হানেদা বিমানবন্দরের ঘটনাটির ক্ষেত্রে প্রথম এমন ইমার্জেন্সি এক্সিট ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং এ ঘটনার মাধ্যমেই উড়োজাহাজের জরুরি ব্যবস্থা বাস্তব ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা হয়েছে।