যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস না করে গড়ে তোলা হয়েছে ভেনিস

ভেনিস
  © ফাইল ছবি

ইউরোপের অন্যতম জাদুকরী শহর ইতালির ভেনিস। বহু বছর ধরে গোটা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে মনোমুগ্ধকর এই শহরটি। যাকে ইতালির ভাসমান শহরও বলা হয়। কিন্তু এ ভাসমান শহর এবার পানির নিচে ডুবে যাওয়ার পথে। সম্প্রতি এমনটিই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহরটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২১০০ সালের মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে ইতালির স্বপ্নের শহর ভেনিস। তবে শহরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেক কিছু করা যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন তারা। ডয়চে ভেলে।

ভেনিস ডুবে যাওয়ার খবর নতুন কিছু নয়। এ মায়ার শহর যে ডুবে যাবে তা শত শত বছর আগেই জানা গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে একটি উপহ্রদে নির্মিত শহরটি সব সময় বন্যার ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাটি তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। ফলে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়েই কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল যে ভেনিস ডুবে যাচ্ছে। ভেনিস কেন ডুবছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ কয়েকটি তত্ত্ব সামনে এনেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ভেনিস ডুবে যাওয়ার অন্যতম কারণ, এর চার পাশ পানি দিয়ে বেষ্টিত হওয়ায় ভবনগুলোর অত্যধিক ওজনের কারণে এটি ধীরে ধীরে নিচে চলে যাচ্ছে। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও শহরটিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দেড়শ বছরে ভেনিস ২০ সেন্টিমিটার নেমে গেছে।

যদিও ভেনিসের ডুবে যাওয়ার সঠিক সময়সীমা জানা যায়নি। তবে অনেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২১০০ সালের মধ্যে শহরটি পানির নিচে ডুবে যেতে পারে। শহরটিকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ভেনিসের আশপাশে এবং অনেক প্রকল্প চলমান থাকায় এগুলো এই শহরে অনুপ্রবেশকারী পানির অগ্রগতিকে মন্থর করতে পারে। বর্তমানে এটিকে রক্ষা করা স্থানীয়, রাজ্য এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের জন্য একটি শীর্ষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। 

ইতোমধ্যেই বন্যা রোধ করতে ভেনিসের চারপাশে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও মোজে প্রণালির মাধ্যমে ভেনিস কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। পানি থেকে সুরক্ষার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে মোজে প্রণালিতে ৭৮টি ইস্পাতের প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সহায়তা করে। ভেনিসের বন্যা সুরক্ষা কমিশনার এলিজাবেতা স্পিৎস বলেন, ‘মোজে না থাকলে ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর ভেনিস অপূরণীয় ধ্বংসলীলার শিকার হতো। ইতিহাসে দ্বিতীয় উচ্চতম বন্যার স্তর সত্ত্বেও আমরা ভেনিসকে বাঁচাতে পেরেছি।’ 

সমুদ্রবিজ্ঞানীর গেয়র্গ উমগিসা বলেছেন, মোজে প্রণালির মাধ্যমে ভেনিস শুধু কিছুটা বাড়তি সময় পেয়েছে। তবে এই সমুদ্র গবেষকের মতে, ভেনিস অনন্তকাল টিকে থাকতে পারবে না। কোনো এক সময়ে উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। তখন ভেনিসের মানুষকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তবে ভেনিস কবে ডুবে যাচ্ছে বা আদৌ ডুবছে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রকৃতি ধ্বংস না করেও যে একটি বড় নগর বা সভ্যতা গড়ে তোলা যায় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ইতালির ভেনিস। একটি শহরের ভেতর দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে যাচ্ছে দেড়শ’র বেশি খাল। সেই খাল কেউ দখল করে না, ময়লা আবর্জনা ফেলে না। বরং প্রকৃতির দেয়া খালগুলোকে ঘিরেই গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সব স্থাপনা।

ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানেল বা প্রধান খালের পাশের ভবনগুলো এমনভাবে তৈরি করা, যেখানে যেতে হবে নৌকায় করে। পুরো শহরজুড়ে ছোট-বড় এমন খাল ১৭৭টি। এসব খালের ওপর সেতু আছে ৪শ’ টি। এসব জায়গায় কেউ ভবন নির্মাণের কথা চিন্তাও করে না। খালের কোথাও আবর্জনা দূরের কথা একটি প্লাস্টিকের বোতলও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

প্রতি বছর ৩০ লাখেরও বেশি পর্যটক আসে এই শহরে। তাদের জন্য আছে আধুনিক সব ব্যবস্থাপনা। শহরটি তৈরি হয়েছে কাঁদা-মাটির ওপর। সেই মাটি শক্ত করা জন্য লাখ লাখ গাছের গুড়ি পাইল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই খাল ভরাট করা হয়নি। বরং কিছু খাল খনন করে প্রশস্ত করা হয়েছে।

ভেনিসের অধিবাসী থেকে শুরু করে পর্যটকরাও কেউ খালে কোন ময়লা ফেলে না। বরং কয়েকশ’ বছর ধরে সরকার ও নগরবাসী মিলে খালগুলো রক্ষা করে আসছে।

বিপরীতে বলা হয় ঢাকায় একসময় ৪৭টি খাল ছিলো। এর মধ্যে ২১টির কোন অস্তিত্ব এখন আর নেই। যেগুলো এখনও টিকে আছে সেগুলো খাল নয় নদর্মায় পরিণত হয়েছে। আর এভাবেই আমরা আমাদের শহরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধ্বংস করে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধকেই বরণ করতে চলেছি।


মন্তব্য