যুদ্ধবিরতি.চুক্তির চেষ্টা থেকে সরে লেবানেনে ইসরায়েলি হামলায় আমেরিকার সমর্থন

ইসরায়েল
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় লেবানিজ রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধার তৎপরতা  © আনাদোলু

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি লেবাননেও গণহত্যা শুরু করেছে দখলদার ইসরায়েল। কয়েক মাস ধরেই লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাত চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যৌথভাবে দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা, ১ অক্টোবর থেকে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযান শুরু করা এবং ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হওয়ার পর ওই চেষ্টা মূলত মুখ থুবড়ে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে লেবানন–ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। নতুন কৌশলটি হচ্ছে, যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করার চেষ্টা না করে বরং ইসরায়েলি হামলায় সমর্থন দেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশল পাল্টানোর ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত সপ্তাহে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যে। মিলার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘হিজবুল্লাহকে অবকাঠামোগতভাবে দুর্বল করার জন্য ইসরায়েলের হামলাগুলোকে আমরা সমর্থন করছি, যাতে শেষ পর্যন্ত এই সংঘাতের একটি কূটনৈতিক সমাধান পাওয়া যায়।’

যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলটিকে একই সঙ্গে বাস্তবসম্মত ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বর্তমানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের একটিই শত্রু, যার নাম হিজবুল্লাহ। ইরান এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হুমকি হিসেবে বহুদিন ধরেই ব্যবহার করছে। ফলে হিজবুল্লাহ দুর্বল হলে বা পরাজিত হলে ইসরায়েল যেমন উপকৃত হবে, তেমনি উপকৃত হবে যুক্তরাষ্ট্রও।

কিন্তু হিজবুল্লাহকে দুর্বল করতে গিয়ে লেবাননে একের পর এক ইসরায়েলি হামলার ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা জন অল্টারম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হিজবুল্লাহকে দুর্বল করতে চায়। তবে এই কাজ করতে গিয়ে আঞ্চলিক সংঘাত সৃষ্টি হয় কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যা এখনও চলামান। ওই সংঘাত শুরুর পর হামাসকে সমর্থন দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রায়ই হামলা করতে শুরু করে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ।

এরপর হিজবুল্লাহর আক্রমণ ঠেকাতে লেবাননে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের পাশপাশি গত মাসে পেজার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হিজবুল্লাহর বহু সদস্যকে হত্যা করে ইসরায়েল।

এরপর হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হলে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

কিন্তু জো বাইডেনের আহ্বান উপেক্ষা করে কয়েক দিনের মধ্যেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দক্ষিণ লেবাননে হামলা জোরদার করেন এবং স্থল অভিযানের নির্দেশ দেন।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির আশা কার্যত ছেড়ে দেয় এবং নতুন কৌশল গ্রহণ করে। ইউরোপীয় একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, এখন যুদ্ধবিরতির কোনো আলোচনাই চলছে না। চলতি মাসের পুরোটা না হলেও অন্তত এক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল লেবাননে অভিযান অব্যাহত রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত দুইজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলের এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলি অভিযানকে এখন সমর্থন দিচ্ছে? এতে অন্তত দুটি উপকার হবে যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথমত, হিজবুল্লাহ শক্তি হারাবে। এতে এই অঞ্চলে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইরানও দুর্বল হবে। আর ইরান দুর্বল হলে যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ। কারণ ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্রমশ হুমকি হয়ে উঠছে।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চায় লেবাননে একটি নির্বাচিত সরকার আসুক এবং হিজবুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করুক। কারণ কয়েক দশক ধরে লেবাননে একটি বিকল্প সরকার হিসেবে ক্ষমতাচর্চা করছে হিজবুল্লাহ।

তবে যুক্তরাষ্টের এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করেন পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা, বর্তমানে নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি সেন্টারে কর্মরত জানাথন লর্ড। তিনি বলেন, ‘একদিকে, লেবাননের অনেক মানুষ লেবাননে হিজবুল্লাহ’র উপস্থিতি নিয়ে বিরক্ত। তবে একইসঙ্গে…এই পরিবর্তনটি লেবাননের ওপর অত্যন্ত চরমপন্থি প্রচারণার মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘প্রস্তাবনা ১৭০১’ কার্যকর করা। এই প্রস্তাবনাটি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরায়েল ও লেবানন সেনাবাহিনী উভয়েই হাত থেকে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বাধ্য হবে।

কিন্তু এটি যদি কার্যকর করা সম্ভব না হয়, তাহলে লেবানন আরেকটি গাজায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি ও আল জাজিরা