খাবারে প্রস্রাব মেশানো নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিতর্ক, অতঃপর...

ভারতে
  © ফাইল ফটো

ভারতে খাবার বিক্রেতাদের থুথু ফেলার ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই মানুষ হতবাক হয়ে ওঠেন, একইসঙ্গে ক্ষুব্ধও। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তা ‘ফ্যাক্ট-চেকিং’ ওয়েবসাইটগুলো খারিজ করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এ সংক্রান্ত ভিডিওগুলোর মধ্যে একটায় যে গৃহকর্মীকে খাবারে মূত্র মেশাতে দেখা গিয়েছিল, সেখানে কেউ কেউ দাবি করেছিলেন ওই নারী মুসলমান। ‘ফ্যাক্ট চেকিং ওয়াবসাইটে’ এই দাবি সঠিক নয় বলে জানানো হয়েছিল। পরে পুলিশও জানিয়েছে, ওই নারী একজন হিন্দু।

বিজেপি-শাসিত উত্তরাখণ্ড এবং উত্তর প্রদেশের বিরোধী দলের নেতাদের অভিযোগ, মুসলমানদের নিশানা করতে এর ব্যবহার করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, তাদের অভিযোগ, সরকার বেকারত্ব এবং আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির মতো গুরুতর সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এই জাতীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য এবং খাদ্যাভাস সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় ভারতে সংবেদনশীল বিষয়। কারণ এটা ধর্ম এবং দেশের শ্রেণিবদ্ধ বর্ণ ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। খাদ্যকে ঘিরে নিয়ম, ধ্যান-ধারণা এবং তথাকথিত বিধিনিষেধ কখনো কখনো সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের জন্ম দেয়, অবিশ্বাসেরও।

ফলস্বরূপ, ‘খাদ্য সুরক্ষা’ও এক প্রকারে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। কখনো কখনো অন্য উদ্দেশ্যে খাদ্য সুরক্ষার বিষয়কে হাতিয়ার করার অভিযোগও উঠে এসেছে।

প্রসঙ্গত, ভারতে খাদ্য সুরক্ষা একটা বড় উদ্বেগের বিষয়। ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’র তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয় এমন খাবার খেয়ে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের শিকার হন এবং মৃত্যু হয় চার লাখ মানুষের।

বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতে খাবারের মানগত সুরক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে খাদ্য সুরক্ষা আইনের অপর্যাপ্ত প্রয়োগ এবং নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব। এর পাশাপাশি রান্নাঘরের জন্য যথেষ্ট জায়গা না থাকা, নোংরা বাসনপত্র, দূষিত জলের ব্যবহার এবং অনুপযুক্ত পরিবহণ ও স্টোরেজ ব্যবস্থার মতো বিষয়ও এর জন্য দায়ী।

খাবারে বিক্রেতাদের থুথু ফেলার ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই মানুষ হতবাক হয়ে ওঠেন, একইসঙ্গে ক্ষুব্ধও। এরপরেই উত্তরাখণ্ড সরকার এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করার কথা ঘোষণা করে এবং হোটেলের রান্নাঘরে সিসিটিভি লাগানো বাধ্যতামূলক করে। পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয় হোটেলের কর্মীদের বিষয়ে তথ্য যাচাই করতে এবং সিসিটিভি ইনস্টল করা হয়েছে কি না তা-ও লক্ষ্য রাখতে।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মনে করেন এই জাতীয় ঘটনা বন্ধ করতে পুলিশের উচিত হোটেলের প্রত্যেক কর্মীর বিষয়ে তথ্য যাচাই করা। একইসঙ্গে খাবারের দোকানে মালিকের নাম বোর্ডে লিখে রাখা, রাঁধুনি ও ওয়েটারদের মাস্ক এবং গ্লাভস পরা এবং হোটেল ও রেস্তোঁরায় সিসিটিভি ইনস্টল করা বাধ্যতামূলক করার বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে ওই রাজ্যের।

রিপোর্ট অনুযায়ী, যোগী আদিত্যনাথ দুটো অধ্যাদেশ আনার পরিকল্পনা করছেন। তা বাস্তবায়িত হলে খাবারে থুতু ফেলার জন্য জরিমানা এবং ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও হতে পারে।

গত জুলাই মাসে ভারতের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের জারি করা এক নির্দেশিকায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল হিন্দুদের ‘কাঁওর যাত্রার’ পথে যে সমস্ত খাবারের দোকান রয়েছে তার মালিকদের নাম এবং পরিচয় সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য স্পষ্টভাবে লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এ নির্দেশিকার বিরোধিতা করে আবেদনকারীরা শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছিল এই নির্দেশাবলী মুসলমানদের অন্যায়ভাবে নিশানা করে। শুধু তাই নয়, তাদের ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্রসঙ্গত গত বুধবার উত্তর প্রদেশের রাজ্যের বারাকানকি শহরের একটা রেস্তোরাঁর মালিক মোহাম্মদ ইরশাদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রুটি তৈরির সময় থুতু মেশানোর অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদপত্র ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ ইরশাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে উত্তরাখণ্ডের মুসৌরিতে চা বানানোর সময় সসপ্যানে থুতু ফেলার অভিযোগে নৌশাদ আলি ও হাসান আলি নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং জনমানসে ক্ষোভ তৈরির অভিযোগ আনা হয়।

থুতু ফেলাকে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই প্রথম অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এমনটা নয়। কোভিড-১৯ মহামারির সময়, মুসলমানদের নিয়ে একের পর এক ভুয়ো ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে থুতু ফেলতে, ইচ্ছাকৃতভাবে হাঁচতে বা কোনো বস্তু জিভ দিয়ে চাটতে দেখা গিয়েছিল। অভিযোগ তোলা হয়েছিল এই সমস্ত কিছুর পেছনে উদ্দেশ্য হলো যাতে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিওর সঙ্গে হিন্দু কট্টরপন্থিরা মুসলিমবিরোধী বক্তব্য পোস্ট করায় এই ভিডিওগুলো ধর্মীয় মেরুকরণকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।

এদিকে, বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ড এবং উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের নেতারা। তাদের অভিযোগ, মুসলমানদের নিশানা করতে এর ব্যবহার করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, তাদের অভিযোগ, সরকার বেকারত্ব এবং আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির মতো গুরুতর সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এই জাতীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।

কিন্তু উত্তরাখণ্ডের খাদ্য নিরাপত্তা আধিকারিক মণীশ সায়ানা জানাচ্ছেন, খাদ্যের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই এই সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘খাদ্য সুরক্ষা কর্মকর্তা এবং পুলিশ খাবারের দোকানগুলোতে আকস্মিক তল্লাশি চালানো শুরু করেছে। তারা দোকানের কর্মীদের মাস্ক ও গ্লাভস পরার এবং সিসিটিভি ইনস্টল করার জন্য অনুরোধ করছে।’

আইন বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিক ভি ভেঙ্কটেশন বলেন, বিধানসভায় খাদ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত নতুন অধ্যাদেশ এবং আইন নিয়ে যথাযথভাবে বিতর্ক হওয়া দরকার।

তিনি বলেন, ‘আমার মতে, বিদ্যমান আইন (ফুড সেফ্টি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট, ২০০৬ বা খাদ্য সুরক্ষা ও মানদণ্ড আইন, ২০০৬-এর আওতায়) খাদ্য সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং প্রশ্ন উঠবে যে কেন এই নতুন আইন ও নির্দেশিকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে?’

ভেঙ্কটেশন বলেন, ‘সরকার মনে করে যে কঠোর শাস্তি প্রণয়নকারী আইন মানুষকে অপরাধ করা থেকে রুখবে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে আইনের যথাযথ প্রয়োগই কিন্তু মানুষকে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখে।’

এ যুক্তির ভিত্তিতে তিনি পালটা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাহলে কি এই রাজ্যগুলোতে বিদ্যমান আইন এখনো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি?’