গাজায় ১৫ প্যারামেডিক হত্যায় পেশাদারি ব্যর্থতা ছাড়া দোষ পায়নি ইসরায়েল

গাজা
  © ফাইল ছবি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত মাসে গাজায় ১৫ জন ফিলিস্তিনি প্যারামেডিক ও সহায়তাকর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনায় নিজেদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করেছে, ওই হামলায় আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলেও সেনাবাহিনীর নৈতিক আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়নি।

তবে রোববার এই প্রতিবেদনকে নাকচ করেছে প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) এবং ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স।

পিআরসিএসের সভাপতি ইউনিস আল-খাতিব আল-আরাবি টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাফাহতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইসরায়েল যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তা একে অপরের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'দখলদার সেনারা কেন অপরাধমূলক পদ্ধতিতে প্যারামেডিকদের মরদেহ দাফন করেছে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।'

আল-খাতিব আরও বলেন, প্যারামেডিকদের হত্যা করার আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ভিডিওতে ফুটেজেও স্পষ্ট দেখা গেছে, চিকিৎসাকর্মীদের অ্যাম্বুলেন্সে ইমারজেন্সি লাইট জ্বলছিল। এই প্রমাণ থেকেই স্পষ্ট হয়, দখলদার সেনারা ঘটনাস্থলে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না বলে যে দাবি করেছে, তা দাবি মিথ্যা। 

'জাতিসংঘের কোনো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে এই ঘটনার তদন্ত করতে হবে,' বলেন তিনি।

পিআরসিএসও নিহত চিকিৎসাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিবেদনকে 'মিথ্যায় ভর্তি' বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটির মুখপাত্র নেবাল ফারসাখ এএফপিকে বলেন, 'এই প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। এটি হত্যাকাণ্ডকেই ন্যায্যতা দিয়েছে এবং মাঠপর্যায়ের একজন কমান্ডারের ব্যক্তিগত ভুলের ওপর দায় চাপিয়ে সত্যকে আড়াল করছে।'

গত সপ্তাহে পিআরসিএস জানায়, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অভ দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) নিশ্চিত করেছে, তাদের নিখোঁজ একজন চিকিৎসাকর্মী বর্তমানে ইসরায়েলের হাতে বন্দি রয়েছেন।

রোববার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, হত্যা করে গণকবরে সমাধিস্থ করা নিহত সহায়তাকর্মীদের মধ্যে হামাসের ছয়জন 'সন্ত্রাসী' রয়েছে। যদিও এই দাবির পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দেয়নি।

তদন্তে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে অভিযান চালানোর সময় মাঠ পর্যায়ের কমান্ডাররা আংশিক ও ভুল তথ্য দিয়েছেন। পাশাপাশি তাদের একের পর এক 'পেশাদারি ব্যর্থতার' প্রমাণও মিলেছে তদন্তে।

গোলানি রিকনেইসান্স ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডারকে বরখাস্ত এবং ১৪তম ব্রিগেডের কমান্ডারকে তিরস্কার করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

বেশ কিছু সাক্ষ্য ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বও ইসরায়েলের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'কাউকে গুলি করার আগে বা পরে তার হাত বাঁধা হয়েছিল—এমন দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ মিলেনি'।

প্রথমে ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছিল, ওই অ্যাম্বুলেন্স রাতের অন্ধকারে হেডলাইট বা ফ্ল্যাশিং লাইট চালু না রেখেই 'সন্দেহজনকভাবে' এগিয়ে আসছিল। তাদের স্পষ্টভাবে চেনা যাচ্ছিল না। 

কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ভোর হওয়ার আগ মুহূর্তে কনভয়ের গাড়িগুলো রাস্তার পাশে দাঁড়ায়, এরপর কোনো ধরনের পূর্বসংকেত ছাড়াই তাদের ওপর গুলি ছোড়া শুরু হয়। এছাড়া ভিতিওতে দেখা যায়, নিহতদের একজনের হাতে তোলার দৃশ্যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তাদের যথাযথভাবে চেনাও যাচ্ছে। আর তাদের গায়ে চিকিৎসাকর্মীর পোশাকের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সেও লাইট জ্বলছিল। তবুও তাদের ওপর কয়েক মিনিট ধরে গুলি চালানো হয়।

পরে জাতিসংঘ ও ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ইসরায়েলের অনুমতি পেয়ে মিসরের সীমান্তবর্তী রাফাহ শহরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি গণকবর এবং বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া অ্যাম্বুলেন্স ও মৃতদেহগুলো খুঁজে পান। 

ইসরায়েলি দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স বলেছে, সেনাবাহিনীর এই তদন্ত প্রতিবেদন 'পরস্পরবিরোধিত, অস্পষ্ট ভাষায় ভর্তি'। এছাড়া এতে 'বেছে বেছে তথ্য উপস্থাপন' করা হয়েছে। 

সংস্থাটি আরও বলেছে, 'আরেকটি দিন গেল, আরেকটি সত্য ধামাচাপা দেওয়া হলো। আরও নির্দোষ প্রাণ ঝরে গেল, কিন্তু কেউ জবাবদিহির আওতায় এল না।'

তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের চরম ডানপন্থি অংশ মনে করছে, সেনাবাহিনী অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ইসরায়েলের উগ্র জাতীয়তাবাদী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেছেন, ডেপুটি কমান্ডারকে বরখাস্ত করা 'গুরুতর ভুল', এ সিদ্ধান্ত বদলানো উচিত।

এদিকে মানবাধিকার আইনজীবী জিওফ্রে নাইস আল জাজিরাকে বলেন, এই তদন্তের ফলাফল ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আচরণ এবং তদন্ত প্রক্রিয়ার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। 

তিনি টেনে বলেন, ইসরায়েল দাবি করেছিল, নিহত ছয়জন হামাস সদস্য, তা-ও সক্রিয় সামরিক সদস্য। 'কিন্তু সেই দাবির পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিলই উপস্থাপন করা হয়নি।'

ইসরায়েলের অতীত ইতিহাস বলছে, তারা অন্যায় স্বীকারে গড়িমসি করে, আবার আগে দেওয়া বক্তব্যও পাল্টে ফেলে।

আগেও বেশ কয়েকটি তদন্তে সেনাবাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, অথবা পুরো দোষ একজন ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘ সম্প্রতি বলেছে, গত মাসে গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায় ১৫ ত্রাণকর্মীকে হত্যার দায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর। একইসঙ্গে সেখানে একজন বুলগেরিয়ান জাতিসংঘকর্মী নিহত ও ছয়জন বিদেশি কর্মী আহত হওয়ার দায়ও ইসরায়েলি বাহিনীর।

যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় জাতিসংঘ গাজায় কর্মীসংখ্যা ব্যাপক হারে কমাতে বাধ্য হয়েছে।