শীতে বাড়ে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি, সতর্ক থাকবেন যেভাবে

ঠান্ডা
  © ফাইল ছবি

ঠান্ডার এই মৌসুমে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এই সময়ে সামান্য শীতেই ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কিওলাইটিস এমনকি নিউমোনিয়া হতে পারে। এছাড়াও এই সময়ে বাতাসে ধুলা-ময়লার আধিক্যর কারণে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বড়ে যায়। তাই ঠান্ডা না লাগানোর দিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গুরুতর নিউমোনিয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। নিউমোনিয়া রোগের জীবাণু মানুষের ফুসফুস এবং শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং টিবির জীবাণুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়ায়। আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি শিশু এবং বয়স্করা।

নিউমোনিয়া ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ। প্রাচীন গ্রীক শব্দ “নিউমন”থেকে “নিউমোনিয়া” শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে যার অর্থ “ফুসফুস”। “নিউমোনিয়া” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “ ফুসফুসঘটিত রোগ”। সংক্রমণ এবং এর পরবর্তী প্রদাহ থেকে এ রোগ হয়। সংক্রমণ হতে পারে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি দিয়ে। সব সর্দি-কাশিই নিউমোনিয়া নয়। যখন জ্বর এবং এর সঙ্গে থাকে কফ এবং শ্বাসকষ্ট, তখনই কেবল শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ হয়েছে বলে ধরা হয়। নিউমোনিয়া মৃদু বা হালকা থেকে জীবনহানিকরও হতে পারে।

নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ হচ্ছে: জ্বর ও ক্লান্তি অনুভব করা, মাত্রাতিরিক্ত ঘাম ও কাশি হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট, বুকব্যথা ও শরীরে কাঁপুনি, মাথাব্যথা ও শরীরের মাংসপেশি ব্যথা, খাওয়ার প্রতি অনীহা ও বমি বমি ভাব। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীরের রক্তপ্রবাহে জীবাণুর সংক্রমণ দেখা দেয়। ফুসফুসের চারপাশে তরল জমা এবং সংক্রমণ হয়। ফুসফুসে ঘা হয়ে ক্ষত হতে পারে। তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে যারা রয়েছেন: ছোট্ট শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা। বহুদিন ধরে ভুগছে এমন কোনো রোগ থাকলে যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের অন্য কোনো রোগ, এইডস ইত্যাদি থাকলে। যাদের অন্য কোনো কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেছে যেমন: ক্যানসারের চিকিৎসা নিলে, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করলে। যারা ধূমপান করেন।

দুই মাসের নিচের শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৬০ বারের বেশি, এক বছরের নিচে ৫০ বার বা তার বেশি এবং এক বছর থেকে পাঁচ বছরের শিশুর মিনিটে ৪০ বার তা তার বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস হলে তাকে শ্বাসকষ্ট বলা হয়। তাই জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত শিশু এ রকম ঘন ঘন শ্বাস নিলে বা শ্বাসের সঙ্গে বুক বা পাঁজর নিচে দেবে যেতে থাকলে সতর্ক হোন, হয়তো সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।

নিউমোনিয়ার কিছু ভ্যাকসিন বের হয়েছে। ভ্যাকসিনগুলো যদি সময়মতো নেওয়া যায়, তাহলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করবেন যেভাবে
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা বাড়িতেই সম্ভব। এ জন্য সঠিক ওষুধের পাশাপাশি এ সময় প্রচুর তরল খাবার, পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে হবে। নিউমোনিয়া ভালো হতে ২-৩ সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। কুসুম গরম পানি, লবণপানি বা লাল চা দেওয়া যেতে পারে। নাকে নরমাল স্যালাইন, নরসল ড্রপ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্য কোনো ওষুধজাতীয় ড্রপ দেওয়া যাবে না। দুই বছরের নিচের শিশুদের বুকের দুধ বন্ধ করা যাবে না। বুকে তেল বা বাম ব্যবহার করাও উচিত নয়। শিশুদের সামান্য কাশিতে অহেতুক সাকশন যন্ত্র দিয়ে কফ পরিষ্কার বা নেবুলাইজার যন্ত্র ব্যবহারও ঠিক নয়।

তবে অবস্থা সংকটাপন্ন হলে অর্থাৎ খুব বেশি শ্বাসকষ্ট, সবকিছুই বমি করে দিলে, শিশু অজ্ঞান হয়ে গেলে বা খিঁচুনি হলে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সচেতন হলে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনসহ অন্য রোগেরও ভ্যাকসিন নিতে হবে। বিশেষ করে ৫ বছরের নিচে বা ৬৫ বছরের ওপরে বয়সীদের অথবা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম।

নিয়মিত হাত ধুতে হবে। যেমন নাক পরিষ্কারের পর, বাথরুমে যাওয়ার পর, খাওয়ার আগে ও পরে।

ধূমপান বন্ধ করতে হবে। কারণ ধূমপান ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। ফলে সহজেই সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং নিউমোনিয়া হতে পারে। ধূমপায়ীদের নিউমোনিয়া সহজেই জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

শীতের সময় রাতে যারা বিভিন্ন খেলাধুলা করে, যেমন ব্যাডমিন্টন খেলে তাদের একটু সচেতন হওয়া উচিত। কারণ গা ঘেমে তা যদি আবার শরীরে শুকিয়ে যায় তাহলে তা থেকে সাধারণ ঠান্ডা, সর্দি-কাশি হতে পারে। সেখান থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে।

সাধারণ ঠান্ডা লাগলেও খেয়াল রাখতে হবে যেন এটি খারাপ দিকে না যায়। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, পরিমিত বিশ্রাম নিতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিশু জন্মের পর ইপিআই শিডিউলের ভ্যাকসিনগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

শিশুকে চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখাও জরুরি।

শিশুকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া হাঁচি-কাশি আক্রান্ত লোকের সামনে থেকে শিশুদের দূরে রাখুন। সবসময় ধুলাবালি থেকে দূরে রাখুন। শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা। এছাড়া খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে।

বয়স ছয় মাসের কম এমন শিশু যদি বুকের দুধ পান করে, তবে সে নিউমোনিয়ার জীবাণু অনেকটাই প্রতিহত করতে পারবে। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের যদি বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় খাবার খাওয়াতে পারেন, তবে খুব ভালো।

এ সময় শিশুর গোসলে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। শীতে শিশুদের ডায়াপার ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত। এই রোগের চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে কী ধরনের নিউমোনিয়া রোগীকে আক্রমণ করছে তার ওপর। তাই ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ডায়েটে যুক্ত করবেন যে খাবারগুলো
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রচুর পানি পান করতে হবে। এতে করে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন উপাদান বের হয়ে যায়। ফলে শরীর থাকে সুস্থ।

শীতে ডিহাইড্রেশন এড়াতে জলের পাশাপাশি পান করুন টাটকা ফলের রস। এ সময় যত বেশি তরল পদার্থ শরীরে যাবে, ততই ক্ষতিকারক কণা শরীর থেকে বের হয়ে যাবে। ফলে শ্বাসযন্ত্রও থাকবে সুস্থ।

প্রোটিন গ্রহণ করুন। নিউমোনিয়া একটি প্রদাহজনিত সমস্যা। এই রোগ প্রতিরোধে পাতে রাখুন প্রদাহবিরোধী খাবার। অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলে নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত আরোগ্য মেলে। এজন্য পাতে রাখুন বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন- কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, আখরোট ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিদিনের ডায়েটে বিভিন্ন বীজ ও মুরগির মাংসের মতো প্রোটিন রাখুন।

সুস্বাস্থ্যের জন্য শীতে মৌসুমি সব শাকসবজি খেতে হবে। পালং শাক, লাল শাক, কলমি শাক’সহ মৌসুমি সব সবজি পাতে রাখুন। এসবের পুষ্টিগুণ শরীরকে বিভিন্ন রোগের সঙ্গে লড়াই করতে শক্তি জোগায় এমনকি ফুসফুসসের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে।

ভিটামিন সি গ্রহণ করুন। শীতের বাজারে মৌসুমি বিভিন্ন ধরনের ফল মেলে, যেগুলোতে ভিটামিন সি ভরপুর থাক। ভিটামিন সি’যুক্ত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এসবের অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রভাব শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।এছাড়া আদা খাওয়ার মাধ্যমেও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রভাব মিলবে শরীরে। শরীর হোক বা ত্বক এই উপাদান খুবই জরুরি। আদার স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে সবারই কমবেশি ধারণা আছে। এজন্য নিয়মিত আদা চা বা আদা কুচি খেতে পারেন। এমনকি খাবারে মিশিয়েও খেতে পারেন আদা।

রসুনের অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল গুণ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের মোকাবিলা করে। এটা শরীরের তাপমাত্রা কমায় এবং বেশী পরিমাণে শ্লেষ্মা বের করে দিয়ে বুক ও ফুসফুস থেকে কফ পরিষ্কার করে দেয়। রসুন থেঁতো করে নিয়ে গরম দুধ ও পানির সাথে মিশিয়ে খান কিংবা দিনে তিনবার লেবুর রস, মধু ও রসুনের মিশ্রণ খেয়ে সমস্যার সমাধান করুন।

তুলসী পাতা ও গোলমরিচ ফুসফুসের জন্য উভয় উপদানই উপকারী। এইগুলো নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সাহায্য করে। কয়েকটা তুলসী পাতার নির্যাস বের করুন। টাটকা গোলমরিচ গুঁড়া করে একচিমটে মিশিয়ে প্রতি ছয়ঘণ্টা অন্তর খান।

হলুদ মিউকোলাইট হিসেবে কাজ করে শ্বাসনালি থেকে শ্লেষ্মা বের করে। এর অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য সংক্রমণের মোকাবিলা করে। গরম সরিষার তেলের সাথে হলুদ গুঁড়ার পেস্ট বানিয়ে বুকে মালিশ করুন। আপনি দিনে তিনবার এক গ্লাস গরম দুধের সাথে হলুদ গুঁড়া মিশিয়েও খেতে পারেন।

গোলমরিচের মধ্যে অধিক পরিমাণে ক্যাপসাইসিন থাকে, যা শ্বাসনালী ও শ্বসনতন্ত্র থেকে শ্লেষ্মা-কফ বের হতে সাহায্য করে। গোলমরিচ বিটা-ক্যারোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস এবং এর জন্য মিউকাস মেমব্রেন সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায় ও সুস্থ থাকে। পানির মধ্যে গোলমরিচ ও লেবুর রস মিশিয়ে সারাদিনে কয়েকবার খান। গাজরের রসের সাথেও গোলমরিচ যোগ করতে পারেন। উভয়েই কার্যকরভাবে নিউমোনিয়ার নিরাময় করে।

মেথির বীজে মিউকোলাইটিক গুণ থাকে যা কফ বের করে দেয়। এর জন্য ঘাম হয়, যা শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় ও জ্বর কমে। দুইকাপ পানির মধ্যে মেথির বীজ গরম করে নিয়ে সেটা দিয়ে চা বানান। এই মিশ্রণ ছেঁকে নিয়ে খান। মেথির বীজ, আদা, রসুনের কোয়া ও একচিমটে গোলমরিচ দেওয়া হার্বাল চা খেতে পারেন। সমস্যার নিরাময়ের জন্য এটা সারাদিনে কিছুক্ষণ পর পর খান।


মন্তব্য