ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ফাঁকা, সড়কে জটলা

জাতীয়
  © সংগৃহীত

বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট। অধিকাংশ অফিসের কর্মীরা ছুটি শেষে বেরিয়ে পড়েছেন। পুরো বনানী সড়কে বিশাল জটলা। যানবাহনের গতি নেই। জটলা পৌঁছেছে মহাখালী পর্যন্ত। তবে ভিন্ন চিত্র ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী র্যাম্পে। যানবাহনের চাপ নেই। হাতো গোনা দু-একটি বাহন চলছে। নেই গণপরিবহন। সড়কে যানবাহনের চাপ কমাতে উড়াল সড়কের উদ্যোগ নিলেও সেটি খুব কাজে আসছে না। পুরো অংশ চালু হলে এর সুফল কতটা মিলবে সেটি নিয়েও তৈরি হয়েছে সন্দেহ।

ফাঁকা ইউলুপের পাশের সড়কে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেল চালক জুবায়ের আলম। তিনি উত্তরা থেকে ফার্মগেট এলাকায় যাবেন। উড়ালসড়কের নিচে সড়কের জটলায় অতিষ্ঠ তিনি। জুবায়ের বলেন, উড়াল সড়ক মূলত প্রাইভেটকার চালকদের। আমরা কোনোদিন প্রাইভেটকার কিনতেও পারবো না চড়তেও পারবো না। উড়াল সড়ক গণমানুষের করতে হবে। যানজট যদি না কমে তাহলে উড়াল সড়ক নির্মাণ করে লাভ কী?

রাজধানীর ফার্মগেটের যে জায়গায় ঢাকা উড়ালসড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি পথ (লুপ) নেমেছে, সেখানেও দেখা যায় যানজট।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাত্রী নিয়ে যাত্রায় এখনো অনীহা বাসচালকদের। সড়কে যানবাহনের চাপ দেখা গেলেও সে তুলনায় ফাঁকা এক্সপ্রেসওয়ে। ব্যক্তিগত যান বেশি। কিছু ছোট বাণিজ্যিক পিকআপ দেখা গেলেও সে সংখ্যা একেবারে কম। পিকআপ চালকরা জানান, এ পথে চলতে হলে তাদের গুনতে হয় টোলের টাকা। জ্বালানি খরচ মিটিয়ে টোলের টাকা দিয়ে এ পথে চলা তাদের জন্য কষ্টকর। তবে অনেক ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করলে সময় বাঁচে।

বড় বড় প্রকল্প করার আগের কাজগুলো সঠিকভাবে করিনি। নতুন উড়ালসড়কের ক্যাপাসিটি ও নিচের সড়কের ক্যাপাসিটির বিষয়ে আমরা সঠিক পরিকল্পনা করিনি। নিচের সড়কের বিশৃঙ্খলা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, পার্কিং সিগন্যাল, যত্রতত্র বাস দাঁড়ানো নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।- ড. এম শামসুল হক

বাসচালকরা বলেন, সড়কে যাত্রী পাওয়া যায়। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে সে সুযোগ নেই। তাই তারা এখনো চলছেন আদি সড়কে। তার ওপর আছে টোল। সেই টোলের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি বাসভাড়া। তবে মালিক সমিতি বলছে, বাসভাড়া নীতিমালায়ই উল্লেখ আছে, টোলের সঙ্গে ভাড়া কীভাবে সমন্বয় করবে। সে কারণেই যেসব গাড়ি উড়াল সেতু দিয়ে চলতে চায় তাদের ভাড়া নিয়ে কোনো জটিলতা হবে না।

রাজধানীতে যানজট নিরসনে নেওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের চুক্তি সই হয়েছিল ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। কাজ শেষ করতে লাগছে ১৩ বছর। কাওলা থেকে উড়াল সড়কটি যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত। মোট দূরত্ব ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। বর্তমানে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার উড়াল সড়কে চলাচল করছে যানবাহন।

সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞদের দাবি, যেভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে নজর দেওয়া হচ্ছে সেভাবে সড়কের অব্যবস্থাপনায় নজর নেই। সড়কের সিগন্যালিং ব্যবস্থা, ফুটপাত, যত্রতত্র বাস দাঁড়িয়ে থাকা, যাত্রী পেতে বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে সড়কে জটলা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকে নানাভাবে যেভাবে সুবিধা ভোগ করেন সড়কের ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা নিরসনে সেই সুবিধা নেই। এসব কারণেই উড়াল সড়ক নির্মাণের পরও জটলা লেগে আছে। এর মূল কারণ সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয়হীনতা।

উড়াল সড়কের নিচে জটলা প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্প করার আগের কাজগুলো সঠিকভাবে করিনি। নতুন উড়ালসড়কের ক্যাপাসিটি ও নিচের সড়কের ক্যাপাসিটির বিষয়ে আমরা সঠিক পরিকল্পনা করিনি। নিচের সড়কের বিশৃঙ্খলা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, পার্কিং সিগন্যাল, যত্রতত্র বাস দাঁড়ানো নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।’

‘রাস্তার ওপরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের আগের কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। আমাদের ফুটপাত, পার্কিং, সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও বাড়তি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই কাজগুলোর সঙ্গে পয়সা তেমন সম্পৃক্ত নয়। তবে কাজগুলো সড়কের জটলা নিয়ন্ত্রণে অনেক ভূমিকা রাখতে পারবে। সড়কের জটলা নিরসনের দপ্তরগুলোও সঠিকভাবে কাজ করছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যেভাবে নজর দিচ্ছি সেভাবে সড়কের ছোটখাটো কাজে নজর দিচ্ছি না। অবৈজ্ঞানিকভাবে নিজের স্বার্থে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। অথচ নিচের সড়কের জটলা নিরসনে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে না। এটা যদি না করা হয় তবে যতই বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হোক ঢাকা বসবাস উপযোগী নগরীর তালিকায় তলানিতেই থাকবে। আমাদের দুর্বল ফাউন্ডেশনের কারণেই জটলা কমছে না।’

একনজরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে:
এক্সপ্রেসওয়ের তথ্যমতে, উদ্বোধনের পর এখন পর্যন্ত যত গাড়ি চলেছে তার শতকরা ৯০ শতাংশের বেশি ব্যক্তিগত যান। যানজটমুক্তভাবে সহজে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় বলেই ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যাচ্ছে উড়ালপথে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা নিচ্ছে না কোনো গণপরিবহন। কারণ হিসেবে বাসচালকরা বলছেন, তাদের সব যাত্রী ওঠে নিচের সড়কে। কাউন্টারগুলোও নিচের সড়কে। সে কারণে তাদের উড়াল সড়কপথে যাওয়ায় অনীহা।

কম গতির কারণে ঢাকা উড়ালসড়ক বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের অনুমতি নেই। দুর্ঘটনার ঝুঁকির কারণে বাদ পড়েছে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল। পথচারীদের হাঁটাচলাও নিষিদ্ধ উড়ালসড়কে। অদূর ভবিষ্যতে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসব কারণেও অনেকটা ফাঁকা উড়াল সড়ক।

ফাঁকা উড়ালসড়ক ও সড়কে জটলা প্রসঙ্গে সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অপশনাল। কেউ টোল দিলে ব্যবহার করতে পারবে না হলে পারবে না। আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারবো না। তারপরও গত সপ্তাহে দৈনিক ৪০ হাজার যানবাহন এটা ব্যবহার করেছে। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কখনো মোটরসাইকেল চলে না। সামনে অনুমোদন দেওয়ারও পরিকল্পনা নেই।’

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, চুক্তিতে সিএনজিটচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার এবং মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলসহ দুই চাকার যানবাহন চলাচলের সুযোগ রাখা হয়নি। ঢাকা উড়ালসড়কে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলতে পারবে ধরেই নকশা করা হয়েছে। মূল উড়ালপথে ঢাকার আশপাশের বড় মহাসড়কগুলোর সঙ্গে একে যুক্ত করা। তবে এজন্য অপেক্ষা করতে হবে পুরো উড়ালসড়ক চালু হওয়া পর্যন্ত। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে সাভারের ইপিজেড পর্যন্ত নির্মাণাধীন আরেকটি উড়ালসড়কের কাজ শেষ হলে এ প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অপশনাল। কেউ টোল দিলে ব্যবহার করতে পারবে না হলে পারবে না। আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারবো না। তারপরও গত সপ্তাহে দৈনিক ৪০ হাজার যানবাহন এটা ব্যবহার করেছে। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কখনো মোটরসাইকেল চলে না। সামনে অনুমোদন দেওয়ারও পরিকল্পনা নেই।- প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মাহমুদুর রহমান

প্রকল্পের অগ্রগতি
প্রকল্পের প্রথম ধাপের আওতায় ১ হাজার ৪৮২টি পাইল, ৩২৬টি পাইল ক্যাপ, ৩২৫টি কলাম, ৩২৫টি ক্রস-বিম, ৩ হাজার ৪৮টি আই গার্ডার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও ৩ হাজার ৪৮টি আই গার্ডার এবং ৩২৮টি ব্রিজ ডেক স্থাপন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম ধাপের ভৌত অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে দ্বিতীয় ধাপের অগ্রগতি ৬৬ দশমিক ০১ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপের ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৭ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার। এর পরিমাণ ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ বিনিয়োগকারী আর্থিক সংস্থা চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৪৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ৮৬১ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই করা হয়। এর মধ্যে মোট ৩৮২ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ইউএস ডলার ছাড় হয়েছে।

সেতু বিভাগ জানায়, উড়াল সড়কের রুট হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক।

এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য
দ্রুতগতির এ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠানামা (র্যাম্প) করার ব্যবস্থা থাকছে। র্যাম্পসহ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উড়ালসড়কে ১১টি টোল প্লাজা থাকছে। পুরো পথ চালু হলে তা যানবাহনে পাড়ি দিতে ২০ মিনিট লাগবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কাওলা থেকে তেজগাঁও অংশ পাড়ি দিতে লাগবে ১২ মিনিট।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড। শেয়ার হোল্ডার্স ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড (থাইল্যান্ড) ৫১ শতাংশ, চায়না শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ (সিএসআই) ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড ১৫ শতাংশ।

 

তথ্য: জাগোনিউজ২৪.কম


মন্তব্য