বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারালেন যারা

বেইলি রোডে
  © ফাইল ছবি

রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬-এ। তাদের মধ্যে ৪০ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে ৬টি লাশ রয়েছে। এদের মধ্যে তিন জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি জেলা প্রশাসন। মৃতদের মধ্যে দুজনের শরীর পুরো অঙ্গার হয়েছে। ফলে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার পর লাশের দাবিদার স্বজনদের লাশ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

শুক্রবার রাত ৯টায় ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম হেদায়েতুল ইসলাম মোট ৪০ লাশ হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এর মধ্যে ৩৯টি ঢাকা জেলা প্রশাসন ও একটি রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছে। রাজারবাগ হাসপাতালের লাশটির পরিচয়ের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এদিকে আহত ১৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। 

স্বজন ও চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ লাশের শরীরে কোনো পোড়া ক্ষত নেই। মৃতদের অনেকে আগুন লাগার পর পরিবারের লোকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লাগার পর একে একে লাশ আসতে থাকে ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। স্বজনদের অনেকেই রাতেই লাশ নিতে চান। কিন্তু যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া শেষে শুক্রবার সকাল থেকে লাশ হস্তান্তর শুরু হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে লাশ হস্তান্তর করা হয়। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল এলাকা।  

ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুর রহমান বলেন, শুক্রবার সকাল থেকেই লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিহত প্রত্যেকের পরিবারের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় ২৫ হাজার টাকা এবং আহতদের জন্য ১৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। দুজন মিসিং রয়েছে বলে দুই পরিবার আমাদের কাছে আবেদন করেছে। 

এখন পর্যন্ত হস্তান্তরিত ৪০ লাশের মধ্যে ৩৯ জনের পরিচয় জানতে পারা গেছে। তারা হলেন-রাজধানীর কাকরাইলের বাসিন্দা কুরবান আলীর মেয়ে ফৌজিয়া আফরিন রিয়া (১৮), মালিবাগ শান্তিনগরের বাসিন্দা শিপন পোদ্দারের স্ত্রী পপি রায় (৩৬), পপি রায়ের মেয়ে আর্দিতা রায় (১২) ও ছেলে সংকল্প সান রায় (৮), খিলগাঁওয়ের উত্তর গোড়ানের মৃত জহিরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল ইসলাম আসিফ (২৫), আরামবাগের মোহাম্মদ আলীর মেয়ে নাজিয়া আক্তার (৩১), তার ছেলে আরহাম মোস্তফা আহামেদ (৬), বংশালের মুসলেমের ছেলে নুরুল ইসলাম (৩২), সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা জয়ন্ত কুমার পোদ্দারের স্ত্রী সম্পা সাহা (৪৬), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আমজাদ হোসেনের ছেলে শান্ত হোসেন (২৪), মতিঝিল এজিবি কলোনির কবির খানের মেয়ে মায়শা কবির মাহি (২১) ও মেহেরা কবির দোলা (২৯), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শান্তিনগরের বাসিন্দা গোলাম মহিউদ্দিনের মেয়ে জান্নাতি তাজরিন নিকিতা (২৩), রমনার সার্কিট হাউসের বাসিন্দা জহুরা ইসলামের মেয়ে ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা লুৎফুর নাহার করিম (৫০), নিউ বেইলি রোডের জাকির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ জিহাদ হোসেন (২২), যশোর সদরের মধ্যপাড়া ভেকুটিয়ার বাসিন্দা কবির হোসেনের ছেলে কামরুল হাবিব রকি (২০), শান্তিনগরের পির সাহেবের গলির বাসিন্দা মাইনুল হকের ছেলে দিদারুল হক (২৩), মৌলভীবাজার কুলাউড়ার ফজলুর রহমানের ছেলে ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অ্যাড. আতাউর রহমান শামীম (৬৩), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মোয়াজ্জেম মিয়ার ছেলে মেহেদী হাসান (২৭), কুমিল্লা সদরের আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে নুসরাত জাহান শিমু (১৯)। 

এছাড়া একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন, সৈয়দ মোবারক কাউসার (৪৮), তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার (৪০), মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা তুজ জোহরা (১৬) ও সৈয়দা আমেনা আক্তার নুর (১৩) ও ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ (৮)। নিহত সৈয়দ মোবারক কাউসার ইতালি প্রবাসী ছিলেন। তিনি এক মাস আগে দেশে আসেন। এই পরিবারের সবার ইতালির ভিসা হয়েছিল। তাদের একসঙ্গে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ সদরের খানবাড়ি বিনোদপুরের আওলাদ হোসেনের মেয়ে জারিন তাসমীন প্রিয়তী (২০), গুলশানের বাসিন্দা ইসমাইল গাজীর ছেলে জুয়েল গাজী (৩০), শাজাহানপুরের উত্তম কুমার রায়ের স্ত্রী রুবি রায় (৪৮) ও তার মেয়ে প্রিয়াংকা রায় (১৮), গোড়ানের দিনেশ চন্দ্র হাওলাদারের ছেলে তুষার হাওলাদার (২৩)। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার তালগাছিয়া। পাবনার ফরিদপুরের তালেব পরামানিকের ছেলে সাগর (২৪)। তিনি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন ওই ভবনে। 

পিরোজপুর সদরের নুরুল আলমের মেয়ে তানজিলা নওরিন (৩৫), শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার কালারচরের ফজর আলীর ছেলে শিপন (২১), রাজধানীর কাকরাইলের বাসিন্দা ফোরকান আলীর মেয়ে আলিসা (১৩), বরিশাল সদর কাউনিয়ার রিয়াজুল আমিনের ছেলে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র নাহিয়ান আমিন (১৯)। মালিবাগের বাসিন্দা পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি নাসিরুল ইসলামের মেয়ে বুয়েট ছাত্রী লামিশা ইসলাম (২০), বগুড়ার মোহাম্মদ নান্টুর ছেলে মো. নাঈম (১৮), ভোলা সদরের চরকুমারিয়ার মো. সিরাজের ছেলে মো. নয়ন (১৭), নোয়াখালীর সেনবাগের আবুল খায়েরের ছেলে আসিফ (২৫)। এছাড়া হস্তান্তর হয়নি কিন্তু দাবিদার রয়েছে অনলাইন পত্রিকা দ্য রিপোর্ট ডট কমের সাবেক রিপোর্টার অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর (২৫) লাশের।

এদিকে মারা যাওয়া আরও তিনজনের লাশ শনাক্ত করেছে তাদের পরিবার। নিহতরা হলেন-কক্সবাজারের উখিয়া, পূর্ব গোয়ালিয়া গ্রামের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪), তার স্ত্রী মেহেরুন নেসা হেলালী (২৪) ও তাদের মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিলা (৪)। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় মেহেরুনের বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন হেলালী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে গিয়ে মেয়ে, জামাতা ও নাতনির পোশাক দেখে লাশ শনাক্ত করেন। তিনি জানান, শাহজালাল কাস্টমস হাউস কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অফিসে কর্মরত ছিলেন। তিন দিনের ছুটিতে খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু তাদের মোবাইলে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে হাসপাতালে এসে লাশ দেখে শনাক্ত করেন। 

লাশ শনাক্ত করতে না পারায় দুই পরিবারের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এরা হলেন, চাঁদপুর সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের ওয়ালিউল্লাহ খানের ছেলে কেএম মিনহাজ উদ্দিন (২৫)। তিনি রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় থাকতেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি একটি আইটি ফার্মে চাকরি করতেন। ঘটনার সময় তিনি ওই ভবনে ছিলেন। তার লাশ শনাক্ত করতে পারেনি স্বজনেরা। রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা হাজী নজরুল ইসলামের ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৫) নিখোঁজ রয়েছেন। তাকেও শনাক্ত করতে পারেননি স্বজনেরা। ফলে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। 

এদিকে আহতদের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেটিভে চিকিৎসাধীন আছেন ১১ জন। তারা হলেন-ফয়সাল আহমেদ (৩৮), সাদ আহমেদ (২৭), রাকিব হাসান (২৮), সুমাইয়া (৩১), কাজি নাওশাদ হাসান আনান (২০), মেহেদী হাসান (৩৫), আজাদ আবরার (২৪), আফজাল হোসেন (২৫), রাকিবুল ইসলাম (২৪), জহিরুল (২৬) ও ফরিদুল (২৭)। 

সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ দাস বলেন, আহতরা দীর্ঘক্ষণ বদ্ধ ঘরে আটকে থেকে কালো ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন। এখানে যারা প্রাথমিক পর্যায়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন খুবই সংকটাপন্ন ছিলেন। তাকে আমরা আইসিইউতে ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। তার শরীরে থাকা বিষাক্ত গ্যাস বা কার্বন মনোক্সাইড বের করার জন্য হাইপারবরিক অক্সিজেন থেরাপি দিয়েছি। চিকিৎসাধীন কাউকেই শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। তবে যে অবস্থায় তারা এসেছিলেন তার থেকে অনেকটা উন্নতি হয়েছে প্রত্যেকেরই। 
আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন ইকবাল হোসেন (২৪) ও যোবায়ের (২১)।

শুক্রবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আহতদের দেখার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিববুর রহমান বলেছেন, বেইলি রোডে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অগ্নিকাণ্ডের জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করেছি। 

তিনি বলেন, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকার প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দিচ্ছে। পরে তাদের ক্ষতি বিবেচনায় পুনর্বাসনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।