পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান

'কোটায় যারা আসে তারাও কিন্তু মেধাবী'

কোটা
  © আবে হায়াত সৈকত

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।

ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।

সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে সে ব্যাপারে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

পরে গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে গত এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা।

শিক্ষার্থীদের চলমান এই আন্দোলন নিয়ে মতামত দিচ্ছেন অনেকেই। এবার কোটা নিয়ে মুখ খুললেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম তখন দেখেছি, যার কোটায় আসে, আর যারা মেধায় আসে তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকে না। এই ধরেন যে মেধায় ফার্স্ট হয়েছে সে ৭০০ নম্বর পেয়েছে। আর যে কোটায় এসেছে সে ৬৩০ বা ৬৪০ পেয়েছে। এরাও কিন্তু মেধাবী। কিন্তু একটু পিছিয়ে থাকা। কোটায় যারা আসে তারাও কিন্তু সব ধরনের পরীক্ষা দিয়েই আসে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন তো নিয়োগ দেয় না, সুপারিশ করে জানিয়ে তিনি বলেন, তখন আমরা কোটায় যাদের সুপারিশ করেছি, কার্যক্ষেত্রে তো এখন তাদের দেখি কম যোগ্যতা দেখাচ্ছে না। তারাও ভালো করছে। আমি কিন্তু তাদের মেধায় সন্তুষ্ট ছিলাম। যাদের কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করেছি তারাও মেধাবী, আর যোগ্যতায় যারা এসেছে তারাও মেধাবী। যারা কোটায় এসেছে তারা হয়ত একটু পেছনে ছিল। নম্বর হয়ত একটু কম পেয়েছে। আমি দেখেছি, যারা মেধায় চাকরি পেয়েছে আর যারা কোটায় চাকরি পেয়েছে তাদের সবার মার্ক কিন্তু ৫০ এর মধ্যেই ছিল। আমি তাদের মেধায় সন্তুষ্ট ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, সত্যিকার অর্থে বঞ্চিত হয়েছে আদিবাসীরা। বঞ্চিত হয়েছে যারা শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তারা। আর বঞ্চিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তো এখন কারও চাকরির বয়স নেই। আর মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম ধরলে তাদের আমি বঞ্চিত মনে করব না। এটা নিয়ে একটা বিতর্কও থাকতে পারে।

এখনও তো আদালত থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে বোঝা যাবে। এখন আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটা তো সাময়িক সময়ের জন্য। এটা হয়ত খুব বেশি দিন চলবে না।

ওই যে, যাদের কথা বলছিলাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এবং সত্যিকার অর্থে পিছিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো নারীরা। তাদের যে ১০ শতাংশ ছিল, তার ফলে বেশ এগিয়ে আসছিল নারী সমাজ। এই কোটার কারণেই কিন্তু সরকারি চাকরিতে আমরা নারীদের বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম। এরাও কিন্তু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আমরা গত ১০টা বিসিএস অর্থাৎ কোটা উঠে যাওয়ার আগের ৫টা এবং পরের ৫টা পর্যালোচনা করে দেখেছি, নারীদের অংশগ্রহণ একই মাত্রায় আছে। আগেও ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ছিল। এখনও তাই আছে। তাহলে কি নারী কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে? আমাদের তো ৫০ শতাংশ নারী। পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও কম থাকে না। সে হিসেবে তো ২৫ বা ৩০ না নারীদের অংশগ্রহণ তো ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। কোটা থাকলে এই সংখ্যাটা আরও বাড়ত। এখনও কিন্তু আমাদের নারীদের বিরাট একটা অংশ গ্রাম থেকে উঠে আসছে। কোটা থাকলে সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।

এখন আর জেলা কোটার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী বলেন, সুযোগ থাকার পরও সিলেট থেকে তেমন কেউ অংশগ্রহণ করে না। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সিলেট বিভাগের খুব কম সংখ্যক মানুষ পরীক্ষা দেয়। অথচ তাদের প্রচুর সুযোগ আছে। তারপরও তারা অংশ নেয় কম। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলার মানুষ এখন কিন্তু প্রচুর অংশগ্রহণ করছে। আগে কতগুলো অসুবিধা ছিল। সেখানে ঢাকায় এসে ফরম ফিলাপ করা, পরীক্ষা দিতে আসা কঠিন ছিল। এখন সবকিছু অনলাইন হয়ে গেছে। পরীক্ষাও দেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। এখন আর জেলাকে আলাদাভাবে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।

ঢাকাতে যারা বসবাস করে তারা কি সবাই ঢাকার আদি বাসিন্দা? না। সারা দেশ থেকে এসেই ঢাকার বাসিন্দা হয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর থেকেও তারা এসেছে। ঢাকার আদি বাসিন্দা কতজন চাকরি পাচ্ছেন? এখন আপনি যদি জেলা নিশ্চিত করতে চান তাহলে আপনাকে উপজেলায় যেতে হবে। কারণ অনেক উপজেলার মানুষ চাকরি পায় না। ওভাবে চিন্তা করলে তাদেরও তো আনতে হবে।

কোটা সারা পৃথিবীতে আছে দাবি করে পিএসসি সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বা সুযোগ সুবিধা রাখতে হবে সেটা তো আমাদের সংবিধানেও আছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সুবিধা রাখার কথা সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। এটা কোটার মাধ্যমে হোক আর অন্য যে কোনভাবেই হোক তাদের সমাজের মূল ধারার সঙ্গে আনতে সুবিধা দিতেই হবে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে যেটা হয়েছে, সেটা কিন্তু পিছিয়ে পড়ার কারণে নয়। তাদেরটা এসেছে চেতনা থেকে।

তিনি জোড় দিয়ে বলেন, কোটা থাকা উচিত। তবে এটা সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। এর বেশি না। মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্ম রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে যিনি অক্ষম, খুবই গরীব, অসহায় তাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। এর বেশি হওয়া উচিত না।

এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে তিনি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷