শেয়ার মার্কেট লুটের কারিগর প্রফেসর মিজান এখনো অধরা

শেয়ার বাজারে
  © ফাইল ফটো

আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের মাঝে শেয়ার বাজারে যে লুটপাট হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো। তার বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।

হিরোর নাম গণমাধ্যমে এলেও তার উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লোপাটে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো অধ্যাপক মিজান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মীদের মাঝে ক্ষমতায় পট পরিবর্তনে ভোল পাল্টানোর জন্য সুপরিচিত। শেয়ার ব্যবসায় নেমে এক বছরের মধ্যেই ঢাকার বনানীতে প্রায় তিন কোটি টাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন অধ্যাপক মিজান। শেয়ার মার্কেটে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে প্রায় ‘কয়েক শ’ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন হিরো এবং তার উপদেষ্টা প্রফেসর মিজান।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনান্স বিভাগের দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত উল ইসলাম পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বাজার যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে হিরো এবং মিজানের যৌথ প্রয়াস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিনিয়োগকারী বলেন, শিক্ষকতার আড়ালে পুঁজিবাজারে ‘অঘোষিত’ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছেন প্রফেসর মিজান। হিরোর সাথে সংঘ করে মার্কেট থেকে টাকা তুলে নিতে প্রফেসর মিজানের প্রতি আশীর্বাদ ছিল অধ্যাপক শিবলীর, যিনি শেয়ার কারসাজির অন্যতম হোতা আবুল খায়ের হিরোর কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়েছেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়ার সময়ই অধ্যাপক শিবলী ঋণ খেলাপি ছিলেন। অর্থঋণ আদালতে মামলায় ২০০৭ সাল থেকেই টানা প্রায় ১৬ বছর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন তিনি। চেয়ারম্যান পদে চার বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের প্রথম দুই বছর চার মাস পর্যন্ত তিনি ঋণ খেলাপি ছিলেন এবং তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল ছিল।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক বিতর্কিত চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামেরও অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন মিজান। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিবলী এবং হিরোরা বেকায়দায় পড়লেও অধ্যাপক মিজান আছেন বহাল তবিয়তে। ভোল পাল্টে এখন নতুন প্রেক্ষাপটে মিশে যাওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন তিনি।

গত সোমবার একটি বেসরকারি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ত্রাণ তহবিলে টাকা হস্তান্তর করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ড. মিজান। কিন্তু তিনি ওই ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংকের কেউ না হয়ে সেই অনুষ্ঠানে মিজান কীভাবে উপস্থিত হলেন? জানা গেছে, নিজের অপকর্ম ঢাকতে এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আনুকূল্য পেতে ওই ব্যাংকের বিতর্কিত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন মিজান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান একসময় বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সহকর্মীর সঙ্গে খারাপ আচরণ এবং গায়ে হাত তোলার ঘটনায় তাকে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাবি সাদা দলের সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। হিরোর মতো বিতর্কিত ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও টিচারস লাউঞ্জ আধুনিকায়ন করেও সমালোচনার জন্ম দেন মিজান।

হিরোর সঙ্গে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মিলেমিশে শেয়ার কেনা বেচার অভিযোগ আছে। শেয়ার মার্কেটে নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে, অধ্যাপক মিজান বলেন, 'হিরোর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষকের। তার জানা মতে, সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ার কেনা বেচায় বাধা নেই।'

শুধু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলে হিরোর সঙ্গে তার ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন কী করে হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'বনানীতে কেনা ফ্ল্যাটটি হিরোর কাছে বিক্রি করেছেন।'

তিন কোটি টাকায় বনানীর ফ্ল্যাট কিনেছিলেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি এ তথ্যের উৎস জানতে চান এবং পরে নিজেই বলেন, 'ট্যাক্স ফাইলে এ অঙ্ক উল্লেখ নেই।' যেহেতু জমি ও ফ্ল্যাট প্রকৃত মূল্যে রেজিস্ট্রেশন হয় না, তাই ট্যাক্স ফাইলে ওই মূল্য লেখা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক কিনা- এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, 'এটা সরকারকে বলেন।'

একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হিরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও টিচারস লাউঞ্জ আধুনিকায়ন করলেন কী করে- এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, 'যার সামর্থ্য আছে, তিনি অনুদান দিতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা নয়, ছাত্র হিসেবেই অনুদান নেওয়া হয়েছে।'