বিশ্ব পর্যটন দিবস
নিরাপত্তা সংকট; জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ AM , আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ AM
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। এ শিল্পের বিকাশ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কার্যত তা বক্তব্যে সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। আর সুপরিকল্পিত কর্মপন্থা না থাকা ও সৈকত রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। রয়েছে সাগরের আগ্রাসন আর প্রভাবশালীদের দখলদারিত্ব।
আজ শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস। প্রতি বছরের মতো এ বছরও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘টুরিজম অ্যান্ড পিস’, অর্থাৎ ‘পর্যটন শান্তির সোপান’। প্রতিপাদ্যে শান্তির বার্তা থাকলেও দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এমনিতে এই শহরে কিছুদিন ধরে পর্যটকের মন্দা ছিল। গত জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে অনেকটা পর্যটক শূন্য ছিল কক্সবাজার। গত দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটকরা আসতে শুরু করলেও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন তারা।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে কর্ম ব্যস্ততা ফেলে মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ছুটে আসেন সমুদ্রশহর কক্সবাজারে। অবকাশ যাপনের জন্য কক্সবাজার সর্বোচ্চ শান্তির জায়গা এই মনোভাব থেকে পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে থাকে এই শহরের নাম। তবে সম্প্রতি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা পর্যটকদের আতঙ্কিত করেছে।
কুমিল্লা থেকে বেড়াতে আসা সাজেদুল ইমন বলেন, ‘সমুদ্র সৈকতের বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্ক দূর করতে পারে পুলিশ। সমুদ্রসৈকতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুলিশ দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে। কক্সবাজারে এসে দেখছি সৈকতের কোথাও পুলিশের কোনো টহল নেই, যা খুবই ভীতিকর।’
সন্ধ্যায় সমুদ্রসৈকতে হাঁটতে যাওয়া বন্ধ করেছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য অ্যাডভোকেট প্রতিভা দাশ। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় একা এবং পরিবার নিয়েও দেশে এবং দেশের বাইরে ঘুরতে যাই। বিদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার যে ব্যবস্থা তার কাছাকাছিও কক্সবাজারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশাসনের দেওয়ার কথা তারা সেটা দিতে ব্যর্থ। কক্সবাজার বা বাংলাদেশের যেখানেই ঘুরতে যাই নিজের সম্ভ্রমহানির ভয় থাকে। নিরাপত্তা নিয়ে ভাববো- নাকি নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে যোগ করবো সেটা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়।’ এই সংকট থেকে এবং নিরাপত্তাহীনতা থেকে যদি কক্সবাজারকে বের করা না যায় তাহলে পর্যটন শহর হিসেবে কক্সবাজার থেকে পর্যটক বিমুখ হবে বলেও জানান তিনি।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারী ট্রাভেল গ্রুপের এক সদস্য বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নারীরা বর্তমানে বেড়াতে যেতে ভয় পাচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজারে আসতে। মানুষ কোথাও বেড়াতে যায় একটু স্বস্তির জন্য বা কাজের চাপ থেকে নিজেকে আলাদা রাখার জন্য। কক্সবাজারে এসে শান্তির বদলে বিরক্ত হতে হয়। অবকাশ যাপনের জন্য কিটকট চেয়ারে একটু আরাম করার সময় কয়েক মিনিট পর পর চানাচুর, চিপস, পানি, পান-সিগারেট এবং কিটকট ছাতা ব্যবসায়ীদের টানাটানির শিকার হতে হয়। এই পরিস্থিতি সমাধান না হলে কক্সবাজারের পরিবর্তে অন্য জায়গা বেছে নেবেন পর্যটকরা।’
শহরের তারকা মানের হোটেল কক্স টুডে’র জেনারেল ম্যানেজার আবু তালেব শাহ বলেন, ‘কক্সবাজারের যে সৌন্দর্য আছে, তা দেশের বাইরে আমরা এখনো তুলে ধরতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার ওপরই এ খাতের ভবিষ্যত নির্ভর করছে।’
গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর কক্সবাজারে বিশেষ করে সমুদ্রসৈকতে আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেকে। এ কারণে সৈকতে এবং হোটেল-মোটেল জোনেও পর্যটকদের সঙ্গে ঘটছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছুদিন আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক নারীকে কান ধরিয়ে উঠবস ও মারধর করার একটি ভিডিও ভাইরাল হলে এর প্রভাব পড়ে কক্সবাজারের পুরো পর্যটন খাতে। এই সংকট কাটাতে প্রশাসনের বড় ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল।
কক্সবাজারের পর্যটন সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানী বলেন, ‘সারা দেশের মতো কক্সবাজারেও সংকট চলছে। এটি সমাধানের চেষ্টা করছে প্রশাসন। একই সঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুবিধা বাড়াতে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। এরই মধ্যে কক্সবাজারে যে কয়েকটি ছিনতাই এবং সৈকতে নারী হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এই বিষয় প্রশাসন কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এসব যেন আগামীতে আর না ঘটে সে দিকেও কঠোর নজর রাখছে প্রশাসন।’ এই মুহূর্তে কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য নিরাপদ এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে বলেও জানান জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘দেশজুড়ে রাষ্ট্র সংস্কার চলছে। বর্তমানে কক্সবাজারে অধিকাংশ কর্মকর্তা নতুন। আমরা পরিকল্পিতভাবে কক্সবাজারকে সাজাতে চাই। যাতে পুরো বিশ্বে কক্সবাজারের নাম আরও সমৃদ্ধ হয়।’
এদিকে কক্সবাজারে ঘুরে বেড়ানোর প্রধান স্পট সমুদ্রসৈকত। দেখার জন্য রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ মন্দির ও প্যাগোডা, ধাতু ও ব্রোঞ্জের তৈরি বুদ্ধমূর্তি, ছোট-বড় ১৩টি বুদ্ধমূর্তি নিয়ে লাল সিং ও পাশে সাদা সিং নামের বৌদ্ধবিহার, বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া দ্বীপ, চকরিয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, হিমছড়ি ঝরনা। রয়েছে দেশের একমাত্র ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম।
অভিযোগ রয়েছে, এসব পর্যটন স্পট সুরক্ষায় কিংবা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। সরকার বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপের কথা বললেও কার্যত তার কিছুই হয়নি। উল্টো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, লাবনী পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানের বালুকাবেলা দখল হয়েছে অসাধু চক্রের হাতে। আর বালিয়াড়ি দখল করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাইসেন্সও দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময় পর্যটকরা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক সময় ছিনতাইকারী ও টমটম চালকদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছেন অনেক পর্যটক। রয়েছে ভাতের হোটেল ও আবাসিক হোটেলগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও।
সরেজমিন কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট ও কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানির তীব্র স্রোতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমুদ্রসৈকত। গর্ত হয়ে পানি জমে থাকায় ঝুঁকি তৈরি করছে পর্যটকদের জন্য। রয়েছে জেলা প্রশাসনের দেওয়া টোকেন দিয়ে তৈরি করা ঝুপড়ি দোকান। এতে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে পড়ছে। দরিয়ানগর ও হিমছড়ির অবস্থাও একই। জোয়ারের আঘাতে ভেঙে গেছে সৈকতের পাড়। তলিয়ে গেছে কয়েকশ ঝাউগাছ। প্রতিনিয়ত সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হলেও তা রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। পর্যটক হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজার পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ বাধা হতে পারে সুপেয় পানির সংকট। এ ছাড়া পর্যটকদের বিনোদনের জন্য নেই কোনো জাতীয় উদ্যান, থিম পার্ক, হেরিটেজ পার্ক, মেরিন মিউজিয়াম, নেই কোনো আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স সেন্টার। অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাবার বিল, নিত্য পর্যটক হয়রানি, ছিনতাই, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় যেখানে সেখানে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সৈকতে ঝুপড়িগুলো সৌন্দর্য নষ্ট করছে। রাতদিন ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্য ও বখাটের উৎপাত পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে বাধা। এ ছাড়া সাগরে নেই নেটিং ব্যবস্থা। ফলে পানিতে ভেসে গিয়ে ঘটছে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা। এসব বাধার পাশাপাশি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর এখন পর্যটন এলাকায় ছিনতাই ও ভিক্ষুকের কাজ করছে।