গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ ১৮২, একজনেরও হদিস নেই
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৮ AM , আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৮ AM

আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর গাজী টায়ারস কারখানায় হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে তারা কেউ কারখানার শ্রমিক নন। মূলত কারখানার মালামাল লুটপাটকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীরা কারখানায় আগুন দিয়েছে, এতে তারা নিখোঁজ হয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি এই প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়।
২৫ অগাস্ট রাতে অগ্নিসংযোগের পর সকাল থেকেই আশপাশের এলাকার নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার ফটকে জড়ো হয়েছিলেন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে প্রশাসন স্বজনদের কাছ থেকে নিখোঁজদের ছবি ও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে নাম নিবন্ধন শুরু করে।
টানা পাঁচ দিন ধরে জ্বলা আগুনে ভবনটি ভেতরে থাকা কেউ যে আর রক্ত-মাংসে আস্ত থাকবেন না; সেটা ধরে নিয়েই স্বজনরা নিখোঁজদের অন্তত লাশটুকু চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটাও তাদের ভাগ্যে জোটেনি। কারণ আগুনে পোড়া ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনের দাখিল করা প্রতিবেদনে ‘দুর্ঘটনায় আহত, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের বিবরণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে- তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে ফ্যাক্টরির বাইরে বেশ কিছু ব্যক্তি তাদের নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান করতে থাকেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার জন্য কমিটি ১ সেপ্টেম্বর গণশুনানির আয়োজন করে। সেখানে ৮০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য দেন স্বজনরা।
“তাছাড়া উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করে। তালিকাগুলো একত্রিত করে মোট ১৮২ জন ব্যক্তির নিখোঁজ থাকার তথ্য প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায়। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।”
কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করে স্বজনদের হাড়গোড় বুঝিয়ে দেওয়ারও সুপারিশ করেছে।
কমিটি এই কাজটি করার জন্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করলেও জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেছেন, নিখোঁজদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে কোনো চিঠি তিনি পাননি।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ব্যাপক সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন আওয়ামী লীগের অনেক পালিয়ে ও আত্মগোপনে চলে যান।
কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাক্তন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী। তাকে ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন রাতে রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় দেশের বৃহৎ টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। টানা পাঁচদিন পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভাতে সক্ষম হন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক আগুনের সূত্রপাত ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে ২৭ অগাস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি দাখিল করেন কমিটির প্রধান।
ওই ঘটনাকে প্রতিবেদনে নিছক দুর্ঘটনা নয়, ‘অগ্নিসংযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও কারা ওই কাজ করেছে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়নি।
হাড়গোড় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে
হাড়গুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা অধিকতর যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে পুরোপুরিভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি। তবে যে ১৮২টি পরিবার তাদের স্বজনদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে দাবি করছেন, তাদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা পুলিশকে চিঠি দেওয়া হবে।
“এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া হাড়গুলো সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।”
জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, “নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য ভেরিফাই করার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি আসেনি। ফলে এ নিয়ে পুলিশ এ মুহূর্তে কোনো কাজ করছে না।
“তবে যে হাড়গোড় পাওয়া গেছে তা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এসব হাড়গোড় মানুষের নাকি অন্য কোনো প্রাণীর সে বিষয়টি জানার জন্য। তবে সিআইডি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট আসেনি।”
প্রতিবেদনের তালিকা অনুযায়ী, দৈবচয়নের মাধ্যমে অন্তত ৩০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিখোঁজ সদস্যদের কোনো সন্ধান এখনও তারা পাননি বলে জানিয়েছেন। ঘটনার দুই মাস হতে চলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারগুলোর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকে তাদের প্রিয়জনকে জীবিত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে আপনজনকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে নিজ গ্রামের বাড়িতেও চলে গেছেন।
২০ বছর বয়সী ছেলে আমান উল্লাহর কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা বৃদ্ধা রাশিদা বেগম। মোবাইলে অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “বাবা গো, খালি তো ফোন দিয়া জিগাও। পোলাডার খোঁজ তো দিতে পারলা না। সব হাসপাতালে খুঁজছি, সবহানে খুঁজছি। কোনো খবর পাই না। তোমাগো সরকাররে কও, আমার পোলাডার পোড়া লাশটা দিতে না পারুক, হাড্ডিডা দিতো।”
রাশিদা বেগমের মতো একই হাল আমেনা বেগমের। একমাত্র সন্তান অপু মিয়ার (২৬) খোঁজে এখনও গাজী কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেন না।
“দেড় মাস গেলো গা। গাজীর মিলে যাই আর আহি। কেউ ভিতরে ঢুকতে দেয় না। কয়, চুরি করতে গিয়া মরছে, এইটার খবর নাকি কেউ দিবো। এহোন আমার তো পোলা। ওইখানে খাড়াইয়া থাকি ভাল্লাগে। লাশ তো দূরের কথা কাপড়-চোপড়ও পাইলাম না। আমার তো আর চাইর-পাঁচটা পোলাপান নাই, একটাই পোলা আছিল আমার। আমি তো মা, আমার কইলজাটা জ্বলতেছে।”
ডুকরে কেঁদে ওঠেন আমেনা। কাঁদতে কাঁদতে তার ‘পোড়া কপালের’ বৃত্তান্ত শোনান।
স্থানীয় একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন অপু। ঘটনার দিন বেতন তুলেছিলেন তিনি। বেতন নিয়ে ফেরার পথে ভিড় দেখে কারখানার ভেতর ঢোকেন।
আমেনা বলেন, “এলাকার কয়েকজনরে পাইয়া ভিতরে গেছিল আপু। তারে পাই না দেইখা গাজীর মিলে খুঁজতে পাঠাইছিলাম ছোট ভাইরে (নজরুল)। ভাইগ্নারে খুঁজতে গিয়া আমার ভাইটাও নিখোঁজ। যে আগুন লাগাইলো। হের কপালে যেন আগুনটা লাগে।”
আমান রূপগঞ্জের স্থানীয় একটি ব্যাটারি প্রস্তুতকারী কারখানায় কাজ করতেন। তার পরিবারের ভাষ্য, আগুনের ঘটনার রাতে গাজী টায়ারসের কারখানায় আটকা পড়ে ১০টার দিকে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন আমান। আটকা পড়ার কথা বলতে বলতেই কল কেটে যায়। এরপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবার। পরে তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
আমানের খোঁজে কারখানার সামনে ধরনা দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি হাসপাতালে গেছেন স্বজনরা। প্রশাসন, শিক্ষার্থী, ফায়ার সার্ভিস; যে যখন নিখোঁজদের তালিকা করেছেন, সবার কাছেই নিজের ছেলের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। সরকারি কোনো সংস্থাই আমানকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারেনি।