কী ঘোষণা আসছে কাল?

জুলাই
  © ফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন খাত ও ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসন্তোষ দেখা গেছে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানের লেজিটিমেসি (বৈধতা) নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ‘সাংবিধানিকও নয়, বৈপ্লবিকও নয়’ এমনটিও আলোচনায় রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এবার এসব সংশয় ও সংকট দূর করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হতে যাচ্ছে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’। কাল ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের দালিলিক ভিত্তি, লেজিটেমিসি এবং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এ ঘোষণার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে এবং বর্তমান সরকারকে গণ-অভ্যুত্থানের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

জানা গেছে, ঘোষণাপত্রে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির ১৯৪৭ সাল, এরপর ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতি বিষয়সহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপট স্থান পাবে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এ কর্মসূচিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ জন সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়কসহ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের পরিবারের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষাবিদসহ সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত থাকবেন। সরকারের উপদেষ্টারাও উপস্থিত থাকতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। ঘোষণাপত্রটি কে পাঠ করবেন, সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের এক দফার ঘোষক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম কিংবা শহীদ পরিবারের সদস্য কিংবা আহত কোনো ছাত্র এ ঘোষণা দিতে পারেন বলে জানা গেছে। ৩১ ডিসেম্বর এই ঘোষণাপত্র আসলেও তা ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণাপত্রের সব আয়োজন করা হচ্ছে, তাদের সহযোগিতা করবে জাতীয় নাগরিক কমিটি। নাগরিক কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘোষণার মাধ্যমে মূলত বর্তমান ‘মুজিববাদী সংবিধান’কে অপ্রাসঙ্গিক করা হবে। ঘোষণাপত্রে নতুন বাংলাদেশের জন-আকাক্সক্ষার কথাও উঠে আসবে।

নাগরিক কমিটি ও ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সদস্য বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন বিজয়ের পরে নতুন রাষ্ট্রে দেখা যায়নি। বাকশালের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বাকশালের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় আকাক্সক্ষার পরিপন্থী এই বাকশালের বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হবে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে নব্য বাকশাল কায়েম হয়েছে, সেটিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তারপর তরুণদের হাত ধরে চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন বিলোপের ধারাবাহিকতার চিত্রও তুলে ধরা হবে।

এর পাশাপাশি ‘জুলাই প্রক্লামেশনে’ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র রেফারেন্স হিসেবে যুক্ত করা হবে। একাত্তরের মূল চেতনা ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ এই ঘোষণাপত্রে স্থান পাবে। এগুলোর পাশাপাশি নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র মূলনীতি হিসেবে যুক্ত হবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটি সংবিধান সংস্কার কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবে উল্লেখ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে প্রথম রিপাবলিকের এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করে দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রস্তাবনা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নাগরিক কমিটির সদস্য মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক আহসান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অবৈধ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরে পরবর্তী বাংলাদেশকে বাংলাদেশ ২.০ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। এটিই দ্বিতীয় রিপাবলিক।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রান্সে কিং লুইস ফিলিপের পতনের মাধ্যমে ফ্রান্সের জনগণ একটা নতুন গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, নাইজেরিয়াসহ প্রত্যেকটা দেশই একটা ডিক্টেটরশিপের (স্বৈরাচার) পতনের পরে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য একটা সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছে। এটাকেই তারা সেকেন্ড রিপাবলিক হিসেবে আখ্যায়িত করে। যেখানে সব জাতিগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘এ সরকার যে অভ্যুত্থানের সরকার, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা যে এই সরকারকে লেজিটিমেসি দিয়েছে, তা ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে বলা হবে যে এ সরকারটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট। এ সরকারকে আমরা বৈধতা দিচ্ছি। গাঠনিক ক্ষমতার জোরে পাঁচ মাস পরও এই ঘোষণা বৈধ। ইতিহাসে এমন অহরহ ঘটনা আছে। ছাত্র-জনতার কাছে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল একটি সংবিধান। ফ্যাসিস্ট শক্তির অংশ এটিকে জোর করে টিকিয়ে রাখছে। মুজিববাদী সংবিধানটা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক না। বরং বলতে পারি এই সংবিধানের বিরুদ্ধেই আমাদের এই অভ্যুত্থান। আমরা মনে করি, এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম সাংবিধানিক ক্যু। কেননা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেটি হয়নি। জনগণ ইতিমধ্যে এই সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করেছে। জনগণ কী চান, তাদের ইচ্ছে, অভিপ্রায়ই হচ্ছে এখন সংবিধান। তার লিখিতরূপ আসবে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা চাই, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখছি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে।’

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রটি ৫ আগস্টেই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এটি না হওয়ার কারণে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবীপাড়াসহ সব জায়গায় ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। দুই হাজারের বেশি শহীদ ও ২০ হাজারের বেশি আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।’

৩১ ডিসেম্বর যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে, তা বাংলাদেশের একটি লিখিত দলিল হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের একটি দলিল হয়ে থাকবে, যা বিগত সিস্টেম যেগুলো মানুষ গ্রহণ করেনি এবং নতুন যে সিস্টেম চালু হবে, তার পার্থক্য হিসেবে। নতুন যারা দেশ পরিচালনায় আসবেন, তাদের জন্য এ ঘোষণাপত্র একটি নির্দেশক হিসেবে থাকবে। এটি বাংলাদেশের সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরও আগেই দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন সেক্টর থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ২৪-এর বিপ্লবে কী হয়েছে, কোন প্রেক্ষাপটে বিপ্লব হয়েছে এবং বিপ্লব-পরবর্তী দেশ কেমন হওয়া উচিত, সেই প্রেক্ষাপটে একটি আকাক্সক্ষার যাত্রা হবে। তার আলোকেই হবে আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র।’

৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র পাঠ উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসনাত বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় আগ্রাসনের ইনস্টলমেন্ট হয়েছে। ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করা হবে, মুজিববাদী সংবিধান কীভাবে গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে বিনষ্ট করেছে এবং ঠিক কীভাবে আমরা এটার রিপ্লেসমেন্ট করতে চাই। ...সেকেন্ড রিপাবলিক আইনগত বিষয়। এখন এ বিষয়গুলোর দিকে আমরা যাচ্ছি না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রান্তিক জনপদ থেকে শহর পর্যন্ত যারা ৫ আগস্টের আগে এবং ৫ আগস্ট পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময়ে আপনারা বাংলাদেশকে গঠন করার জন্য বিনির্মাণের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তারা একইভাবে ৩১ ডিসেম্বর আমরা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আবার মিলিত হব এবং আমরা আমাদের পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে আকাক্সক্ষা, সে আকাক্সক্ষা আমরা একসঙ্গে ঘোষণা করব।’

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ‘অভ্যুত্থান হলো, এর পেছনের কারণ কী, কেন মানুষ আন্দোলনে এসেছে, এটার দালিলিক প্রমাণ হিসেবে রাখার জন্য এটা হবে। ইতিহাসের পরতে পরতে বিভিন্ন ঘটনা, যা কিছু হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন, এক দফার আন্দোলন হলো এটার কারণগুলো কী। অর্থাৎ সব প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে যেভাবে অভ্যুত্থান হলো, সেটির দালিলিক প্রমাণ এখানে আসবে।’