প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পাচ্ছেন ফটিকছড়ির কৃতি সন্তান  মুহাম্মদ পারভেজ

স্বর্ণপদক
মুহাম্মদ পারভেজ

প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পাচ্ছেন ফটিকছড়ির কৃতি সন্তান  মুহাম্মদ পারভেজ। পারভেজের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার কাজিরহাটে।

ডুয়েটের সাবেক ছাত্র এই পারভেজ গ্রামের মেঠো পথে বড় হওয়া কৃষক বাবার গর্বিত সন্তান ।স্কুলে যেত পাঁচ মাইল হেঁটে। সে এখন অনেক বড়।

একান্ত সাক্ষাৎ কারে পারভেজ জানিয়েছেন  বাবা কৃষক ছিলেন। সংসার চালানো কঠিন ছিল। ছোট থেকেই আমিও হালচাষে দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। সকালবেলা জমিতে চাষ দিয়ে পরে স্কুলে যেতাম। একবার তো স্যার আমার কানে কাদা লেগে থাকতে দেখে মেরেছিলেন খুব। তবু প্রতিবারই ক্লাসে প্রথম হতাম।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে তো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। আমাদের অবস্থা তখন বেশিই খারাপ। বাবা বললেন, ‘অনেক হয়েছে। আর পড়তে হবে না।’ তবু অনেক কাকুতি-মিনতি করে ভর্তি হলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পরদিন থেকে আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। পড়াশোনা বন্ধ। এক বছর বন্ধ থাকার পর একদিন নানা জানতে পারেন, আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। বাবাকে না জানিয়েই আমাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে শান্তিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল বেশ দূরে। আমাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলেন।

স্কুলে আসা-যাওয়া কষ্টের হওয়ায় কাছেই একটা বাড়িতে গৃহশিক্ষক (লজিং) থাকা শুরু করি। ক্লাস সেভেনেও আমার রোল নম্বর এক হয়। এর মধ্যেও কিন্তু মাঝেমধ্যে বাড়ি গিয়ে বাবাকে জমির কাজে সাহায্য করতাম। একদিন সেলিম উদ্দিন নামের এক স্যার আমার অবস্থা জানতে পেরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। স্যার আমাকে একটা সাইকেলও কিনে দিয়েছিলেন। তত দিনে স্কুলের সব স্যারের মধ্যেই আমার সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হয়েছে। আমার স্কুলের বেতন দেওয়া থেকে শুরু করে বই-খাতাও তাঁরা কিনে দিতেন। স্যারদের উৎসাহেই ক্লাস নাইনে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই।

আমি পড়াশোনা করে বড় হই—আমার মা চাইতেন। চাইতেন, আমি যেন তাঁদের কষ্ট দূর করি। তখন তিনি বাড়ির হাঁসের ডিম আর গরুর দুধ বিক্রি করে আমার জন্য টাকা পাঠাতেন। মা পড়াশোনা জানতেন না আর আমাকে ধৈর্য ধরতে বলতেন।

আমার ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার। কিন্তু ধর্মে তো আমি এ+ পাইনি। আমি পারলাম না। এদিকে পরিবারের অবস্থাও ভালো না। আমি তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনী বা পুলিশে যোগ দেওয়ার কথা ভাবলাম। কিন্তু আমার এক আত্মীয় পরামর্শ দিলেন কারিগরি লাইনে পড়লে দ্রুত ভালো চাকরি পাওয়া যাবে। তাই চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই। গ্রাম থেকে এই প্রথম শহরে। এখানেও এক শিক্ষক তিন মাসের জন্য তাঁর বাসায় থাকার সুযোগ করে দেন। কয়েকটা টিউশনিও শুরু করি। এখানেও আমি নিয়মিত প্রথম হচ্ছিলাম। এর মধ্যে বাবা কৃষিকাজের পাশাপাশি ট্রাক্টর ইঞ্জিনযুক্ত মালবাহী গাড়ি চালানো শুরু করেন। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। সে সময় বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে আমরা ঋণে জড়িয়ে পড়ি। তা শোধ করার জন্য টিউশনের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দিই।

২০১৯ সালে বিএসসি শেষ করি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে। বিএসসিতে আমার সিজিপিএ ছিল ৩.৯২।  

সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার একটা সুযোগ থাকে। আমারও ইচ্ছা আছে ডুয়েটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার। 

আজ আমি প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকের জন্য মনোনীত। আমার এ অবদান আমার বাবা,মা,আমার নানার পরিবার, আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবের, আমি সবার নিকট দোয়া কামনা করি।

বর্তমানে পারভেজ উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে শরিয়তপুরে কর্মরত আছেন