আগামীকাল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন?

তুর্কি
তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী

“রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান যদি আবার জয়লাভ করেন, আমাদের সবার জীবন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠবো,” বলেন ইস্তাম্বুলের এক শিক্ষার্থী, ২৩ বছর বয়সী পেরিত। তুরস্কের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোয়াজিচি ইউনিভার্সিটিতে একজন সরকারপন্থী ডিন নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে প্রায় দু’মাস জেলে থাকতে হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমেই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই প্রথম সবচেয়ে কঠিন এক নির্বাচনী পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছেন।

তুর্কী প্রেসিডেন্টের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কুলুচদারুলু। ছয়টি বিরোধী দল নিয়ে গঠিত জোট ‘টেবিল এবং সিক্সের’ প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। আরো কিছু সরকারবিরোধী গ্রুপও মি. কুলুচদারুলুর প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে। একারণেই ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা মি. এরদোয়ানের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন।

এবারের নির্বাচনে যারা ভোট দিচ্ছেন তাদের আট শতাংশ ‘ফার্স্ট-টাইম ভোটার’ যারা প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছেন। অনেকে মনে করেন তুরস্কে যেসব গ্রুপ এখনও মনস্থির করেন নি যে তারা কাকে ভোট দেবেন, তাদের মধ্যে এই গ্রুপটি সবচেয়ে বড়।

তবে ২০ বছর বয়সী সালিহ কাকে ভোট দেবেন সেটা তার কাছে পরিষ্কার। তিনি বলেন, “আমি মনে করি রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তুরস্কের রাজনীতিতে এধরনের ক্যারিশমা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি বিশ্বাস করেন মি. এরদোয়ান তার শাসনামলের বিভিন্ন অর্জনের ওপর ভিত্তি করে তুরস্কের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবেন।

“এর আগে তুরস্কে জ্বালানির বিষয়ে অনেক সমস্যা ছিল এবং সামরিক কারণে দেশটিকে অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের গাড়ি উৎপাদন করছি, ড্রোন ও বিমান তৈরি করছি। মি. এরদোয়ান আমাদের সব সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন,” বলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় সব প্রার্থী এবার তরুণ ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। মি. এরদোয়ান জোর দিয়েছেন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতির ওপর, কিন্তু বিরোধী প্রার্থী মি. কুলুচদারুলু আরো বেশি স্বাধীনতা ও উন্নত কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কিন্তু ২০ বছর বয়সী গিজেম মনে করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই তুরস্কে সবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। “আজকের তুরস্কে যে যা করতে পছন্দ করে সেটাই সে করতে পারে। কয়েক দশক আগে তার বিরোধীরাই লোকজনের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। আমার মতো যেসব নারী হিজাব পরতো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না,” বলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার শাসনামলে বড় ধরনের যেসব সংস্কার ঘটিয়েছেন তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরিতে নারীর হিজাব পরার ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া।

“আজকের দিনে এই দেশে যদি হিজাব পরিহিত কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা শিক্ষক থাকেন, তাহলে সেটা সম্ভব হয়েছে মি. এরদোয়ানের জন্য। তিনিই এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি যদি এটা না করতেন তাহলে আজকেও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমাদের এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থাকতে হতো,” বলেন তিনি।

যেসব নারী সরকারি চাকরি করেন তাদের হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে বিরোধী প্রার্থী মি. কুলুচদারুলু গত বছর পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। তখন মি. এরদোয়ান এই প্রস্তাবের ওপর গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেন। এই বিষয়টির এখনও কোনো সমাধান হয়নি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরো দুজন প্রার্থী লড়ছেন: মধ্য-বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী মুহাররাম ইঞ্জে এবং ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী সিনান ওয়ান। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে তরুণ ভোটারদের কাছে এই দুজন প্রার্থীর আবেদন রয়েছে। এ কারণে প্রধান বিরোধী জোটের সমর্থকরা আশঙ্কা করছেন যে মি. কুলুচদারুলুর ভোট ভাগ হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফার ভোটাভুটিতে গড়াতে পারে।

কোনো প্রার্থী ভোটারদের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর রবিবারের নির্বাচনে কেউ যদি অর্ধেকের বেশি ভোট পান তাহলে তিনিই সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

এবারের নির্বাচনে নারী ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন সেটাও জয় পরাজয় নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কে মোট ভোটারের ৫০.৬% নারী। ধারণা করা হয় যে দেশটির রক্ষণশীল নারীরা দুই দশক আগে মি. এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছিলেন, যে কারণে তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সমর্থন এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

পারিবারিক নির্যাতনের হাত থেকে নারীকে রক্ষা করার জন্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল সেই ইস্তাম্বুল সনদে তুরস্ক সই করেনি। একারণে তিনি বহু নারীর সমর্থন হারিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নারীরা বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিল।

অতীতে মি. এরদোয়ান যেসব নারী এখনও মা হননি তাদেরকে তিনি “অর্ধেক নারী” বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি একজন নারীকে অন্তত তিনটি সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আরো বলেছিলেন যে নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখা সম্ভব নয়।

মি. এরদোয়ান পিপলস এলায়েন্স নামের যে জোট থেকে প্রার্থী হয়েছেন সেই জোটে রয়েছে চরম ইসলামপন্থী দল- হুদা পার। একারণে তার নিজের দল একে পার্টির অনেক নারী এমপির মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে।

নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত গুলসুম কাভ বলছেন বর্তমান সরকার নারী পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন মি. এরদোয়ানের শাসনামলে নারী স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।

“শর্টস পরার কারণে নারীদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, নারী সঙ্গীত শিল্পীরা যে ধরনের পোশাক পরেন তার জন্য তাদেরকে জেলে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এবং যৌন হয়রানির সমালোচনায় করায় শিল্পীদের সাজা দেওয়া হচ্ছে।” “তারা চায় নারীরা ঘরে বসে থাকবে, কিছুই করবে না। কিন্তু নারীরা তো বদলে গেছে। তারা তুরস্ককেও বদলে দেবে,” বলেন তিনি।

সূত্র: বিবিসি