জুলিও কুরি পদক ও বঙ্গবন্ধু

মতামত
জুলিও কুরি পদক ও বঙ্গবন্ধু  © টিবিএম ফটো

বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক জুলিও কুরি পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশের কোনো নেতা প্রথম এ ধরণের আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে।  বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি দেশের প্রায় উপস্থিত সকল সদস্য একমত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে গেছেন।  দেশের জন্য দীর্ঘ ১২ বছরের অধিক সময় কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে করেছে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা।  তাঁর সারা জীবনের দর্শন, মানুষকে ভালোবাসা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা, অসীম সাহস ও তার সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপটে বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করে। পরের বছর ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে পদক পরিয়ে দেন শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে এমন একটি পুরস্কার প্রাপ্তি  বাঙালি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল । বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করেছেন। তাইতো, সেই অনুষ্ঠানে সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’

এখন আসা যাক জুলিও কুরি পুরস্কার সম্পর্কে। এ পুরস্কারটি দুজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানীর নামকরণে করা হয়।  তাদের  একজনের নাম জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও ক্যুরি এবং অন্যজনের নাম ইরেন জোলিও ক্যুরি। যৌথভাবে তাঁরা নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ দুজন বিজ্ঞানী গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন এবং সৈনিকদের জন্য হাতিয়ার তৈরি করে অবদান রাখেন। তাঁর অবদানের কারণেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে সহজতর হয়। ইউরোপ ও সারা দুনিয়ার জন্য এই যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ছিল খুবই জরুরি। প্রশ্ন আসতে পারে, গেরিলা যোদ্ধা ও অস্ত্র তৈরি করে কিভাবে তাদের নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়? এ বিতর্ক তো আছেই, তবে এ কথা বলা যায় যে, যুদ্ধ পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও ক্যুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বশান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে ‘জোলিও ক্যুরি।

পড়ুন>>> বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির ৫০ বছর আজ

জুলিও কুরি পুরস্কার কাদেরকে দেওয়া হয়?  মূলত, বিশ্বে নিপীড়িত ও মেহনতি মানুষদের জন্য যারা আত্মত্যাগ করে ও জীবন উৎসর্গ করেন তাদেরকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল এর ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় যে, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চি মিন, চিলির গণ-আন্দোলনের নেতা সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের জনদরদি নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ স্বাধীনতাকামী নেতা এই পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং ও এ পুরস্কারে ভূষিত হন। 

সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা এবং মানবতার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তাঁরা এই পদকে ভূষিত হয়ে আসছিলেন ১৯৫০ সাল থেকে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতাকামী, নিপীড়িত ও শ্রমজীবী মানুষের এক অতুলনীয় নেতা। তিনি শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তার নেতৃত্বের গুণ ও ব্যক্তিত্ব, দেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন করেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ হয়।  তিনি শুধু বাংলার মানুষের জন্য কথা বলেননি, বিশ্বের সকল মেহনতি, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রকামী, সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচারক, ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী একজন রাষ্ট্র নায়ক।  এ সামগ্রিক গুণাবলীর জন্য বঙ্গবন্ধুকে এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু ও জুলিও কুরি পদক এ আলোচনা আসলে এ কথা নিঃসন্দেহ বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার একনিষ্ঠ কর্মী ও অহিংস আন্দোলন প্রচারের অগ্রদূত।  সারা জীবন তিনি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ পরিচালনার আদর্শ প্রচার করেন এবং নিজের জীবনে তার প্রতিফলন করেন।  ১৯৪৬ সালে তিনি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন।  নিরীহ নারী-পুরুষদের আগলে রেখে জীবন বাঁচান। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি ছিলেন অধিক মনোযোগী। তাইতো ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে তে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি বাঙালিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য মনোনিবেশ করেন। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭০ এর মতো প্রতি ঘটনার সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।  বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চ এর ভাষণে সহিংস পন্থার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে বলেন ।

বঙ্গবন্ধু মানবাধিকারের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।  নিপীড়িত ও দরিদ্র মানুষদের প্রতি তার ছিল ভালোবাসা।  তাইতো তিনি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন, পৃথিবী দুভাগে বিভক্ত, কিন্তু তিনি শোষিতের পক্ষে। তিনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মানবাধিকারের সমুন্নত রাখতে ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।  তিনি মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রামে সমর্থন করেছেন।  তিনি বলতেন, অস্ত্রের জোরে মুক্তি আন্দোলন স্তব্ধ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন । তিনি ইসরায়েল কর্তৃক জোরপূর্বক ফিলিস্তিন দখলে রাখার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার । বঙ্গবন্ধু বলতেন, "আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টাকে।" এমন স্পষ্ট কথা বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশের নেতাও উচ্চারণ করতে পারেনি।  এসমস্ত কারণে শেখ মুজিব ও জুলিও কুরি পদক প্রাসঙ্গিক।

১৯৭৩ থেকে ২০২৩ সাল।  পার হয়েছে অনেকগুলো বছর। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক বাঙালি জাতির জন্য ছিল সম্মানের।  তাইতো সেদিন পদক প্রাপ্তি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’  এখানেই বঙ্গবন্ধু বিশাল মননের অধিকারী। বাংলার মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস ও সম্মান। তার এ উক্তিতে প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।  

 

লেখক

অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম, 
পিস এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্য